শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সমাজের ভয়ংকর ব্যাধির প্রকাশ

ফানাম নিউজ
  ০৩ অক্টোবর ২০২১, ২১:২৩

আত্মহত্যা। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে দেশের একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এসব আত্মহত্যার নির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও শিক্ষার্থীদের পরিবার-বন্ধু মহলের ধারণা, ‘হতাশা’ ও ‘বিষাদ’ থেকেই এমনটি ঘটেছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’র সাম্প্রতিক এক জরিপ মতে— করোনাকালে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যাদের অধিকাংশই হতাশা থেকে এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছেন? এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সমাজের দায় কতটুকু? সংকট নিরসনে করণীয় কী? এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে কথা বলেছে তিন শিক্ষাবিদ-গবেষকের সঙ্গে। এ তিনজন হলেন—লেখক, গবেষক ও এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

হাজারো শিক্ষার্থীর শিক্ষক এ তিন বিশ্লেষকের মতে, যদিও আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, তবে যখন কারও সামনে কোনো আশা বা বেঁচে থাকার অর্থ না থাকে, তখনই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এ চিত্র সমাজের সর্বত্রই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সমাজের ভয়ংকর ব্যাধির প্রকাশ। এসব ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে আলাদাভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব আত্মহত্যার ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি এজন্য হতাশাকেই দায়ী করেন।

এ বিশ্লেষক বলেন, ‘আত্মহত্যা হচ্ছে একজন মানুষের জন্য চরমপন্থা। কেউ যখন তার সামনে কোনো আশা বা বেঁচে থাকার সার্থকতা দেখতে না পান, তখন এ পথ অবলম্বন করেন। যদিও আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।’

‘একজন তরুণ শত বাধা অতিক্রম করে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে এসে যখন দেখেন বেকারত্ব, হতাশা এবং বৈষম্য তাকে ঘিরে ধরেছে, তখন তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকে না। আত্মহত্যার আগে কিন্তু তিনি অনেক ভেবে থাকেন। কিন্তু সমাধান পান না। এ চিত্র সমাজের সর্বত্রই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সমাজের ভয়ংকর ব্যাধির প্রকাশ।’

উন্নয়ন বৈষম্যের প্রসঙ্গ তুলে ধরে এ এমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, ‘দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে বলে সরকারের লোকেরা জাহির করে আসছেন। ভালো কথা। কিন্তু তরুণরা বেকার হচ্ছে কেন? আয় বৈষম্য বাড়ছে কেন? মানুষ হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে কেন? তার মানে এ উন্নয়নের সুবিধা গুটিকয়েক মানুষ পাচ্ছে। গণমানুষ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। বড় বড় প্রজেক্ট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে না। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, পাচার হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে সরকার বাজেট ঘোষণা করছে, কিন্তু সেই অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে বিশেষ গোষ্ঠীর পকেটে চলে যাচ্ছে।’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, ‘শিক্ষার্থীদের এ আত্মহত্যার চিত্র প্রমাণ করে যে, উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। মানবিক উন্নয়ন করতে না পারলে বিপর্যয় অনিবার্য।’

অনাকাঙ্ক্ষিত এমন মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘কর্মমুখী শিক্ষায় জোর দিতে হবে। যে শিক্ষা বেকার তৈরি করে, তা মুক্তি দিতে পারে না। কিন্তু আত্মহত্যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নিরাশা-দুঃখবোধ থাকতেই পারে। তাই বলে আত্মহত্যা মেনে নেওয়ার নয়।’

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অবশ্যই আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়ার কথা উল্লেখ করে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘খুঁজে বের করতে হবে কেন এ পথে হাঁটছেন শিক্ষার্থীরা?’

‘আমি বারবার বলি, শ্রেণিকক্ষে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেওয়া যায় না। মানবিক শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষার জন্য আরও অনেক কিছুর দরকার পড়ে। এদিকে আমাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এসে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে কেন, এটি জরুরি ভিত্তিতে অনুসন্ধান করতে হবে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি আছে কি না, পরিবার থেকে কোনো সমস্যা আছে কি না? কেন তারা হতাশায় ডুবছেন? এসবের উত্তর জানা জরুরি। সব আত্মহত্যার কারণ সাধারণীকরণ করলে আবার সঠিক উত্তর আসবে না। যেভাবেই হোক আত্মহত্যার এ পথ বন্ধ করতেই হবে।’

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের মতে, ‘আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না এবং আত্মহত্যাকারী পরিবার, সমাজের জন্য আরও সমস্যা তৈরি করে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। করোনাকালে এ হতাশা আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। শিক্ষিত বেকার বাড়ছে দিনকে দিন। দুর্নীতির কারণে মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছে না। হাইস্কুলের একজন শিক্ষককে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে হচ্ছে, টিআইবির প্রতিবেদন এটি। এই চিত্রে মনে করছেন, বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই বুঝি ভালো। যদিও এটি কোনো সমাধান নয়। লাখ লাখ তরুণ বেকার। তার মধ্যে পাঁচজন আত্মহত্যা করছেন। এদের আমি অবশ্যই গুরুত্ব দেব না। কারণ জীবন মানেই যুদ্ধ। তারা তো জীবনের কাছে পরাজিত। আত্মহত্যা ভীরুতা, কাপুরুষতার চিহ্ন। সুস্থ মানুষ এটাকেই সমাধান ভাবতে পারে না। সবার জীবনেই কষ্ট আছে। তাই বলে সবাই আত্মহত্যা করবে?’

‘শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সমস্যা। সর্বত্রই অনিয়ম-দুর্নীতি। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার গল্পও তো আছে। আজ (আফগানিস্তানের) কাবুলের নারীরা স্কুলে যাবে কি যাবে না, তার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আমরা তো বহু আগে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছি। জীবনকে ইতিবাচকভবে দেখতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কোনো বিষণ্নতা ছিল না। জীবনকে ভালোবাসুন। জীবন জয়ী হবে। মৃত্যুর মৃত্যু চাই, জীবনের জয় চাই’—যোগ করেন রোবায়েত ফেরদৌস।

গত ২৩ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (এক সপ্তাহ) সময়ে চার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর মেলে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পা রেখেও জীবনযুদ্ধের মাঝপথে থেমে যাওয়া চার শিক্ষার্থী হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ইমরুল কায়েস, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) তাহমিদুর রহমান জামিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের (সাবেক) মাসুদ আল মাহাদী (অপু) এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী অমিতোষ হালদার।

এর আগে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস (১০ সেপ্টেম্বর) উপলক্ষে আঁচল ফাউন্ডেশন এক জরিপ প্রতিবেদনে জানায়, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৪২ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। সূত্র: জাগো নিউজ