শিরোনাম
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। প্রায় সব ধরনের ব্যবসায় এক প্রকার ধস নামে। আর্থিক সংকটের কারণে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। করোনার এ প্রভাব পড়ে দেশের আবাসন খাতেও। অনেক ব্যবসায়ীই ব্যাংক লোন আর জমানো অর্থ বিনিয়োগ করে পড়েন সংকটে। স্থবির হয়ে পড়ে ব্যবসা, বন্ধ থাকে নির্মাণকাজ। সূত্র: জাগো নিউজ
তবে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ঘুরে দাঁড়াতে থাকে আবাসন ব্যবসাও। কিন্তু হঠাৎ করে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকায় ফের বাড়তে থাকে সংকট। নির্মাণকাজের অন্যতম প্রধান উপকরণ রড, সিমেন্ট, শিট, অ্যাঙ্গেল, বালি আর পাথরের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপুল সংখ্যক নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট পড়ে আছে অবিক্রিত অবস্থায়। তবে বাড়তি দাম গিয়ে পড়ছে ভোক্তার ঘাড়েই। লোকসান গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের দামও কমে আসবে।
বর্তমান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নির্মাণকাজের অন্যতম প্রধান উপকরণ রডের দাম দফায় দফায় বেড়ে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতি টন রড এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। দাম বেড়েছে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত অ্যাঙ্গেল, শিট, মোটা প্লেট, পাতলা প্লেট, বালু, পাথর ও সিমেন্টের। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতে। অর্থনৈতিক মন্দা, দীর্ঘদিন কার্যক্রম বন্ধ, নতুন গ্যাস সংযোগে সাময়িক স্থগিতাদেশ এ সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত মার্চের দিকে রডের দাম বেড়ে যায় আকাশছোঁয়া। এরপর গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন হলে দাম কমে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা টনে নেমে আসে। পরে লকডাউনের মধ্যেই বাড়তে থাকে দাম। গত তিন-চার মাস আগে ভালো মানের রড ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চার মাস আগে মোটা প্লেট বিক্রি হয়েছে প্রতি টন ৬৫ হাজার টাকায়, এখন ৫০ হাজার টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ১৫ হাজার টাকায়। বাজারে পাতলা প্লেট এর আগে ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এখন টনপ্রতি এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা বিক্রি করতে দেখা গেছে। তিন-চার মাস আগে এক টন অ্যাঙ্গেল বিক্রি হয় ৫৭ হাজার টাকায়। এখন ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এর আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭ সালের জানুয়ারির পর) ভালো মানের (৬০ গ্রেডের ওপরে) এক টন রডের দাম ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। সেটিই দেশের বাজারে এখন পর্যন্ত রডের সর্বোচ্চ দাম ছিল। পরে রডের দাম কমে ৪৫ হাজার টাকায় নেমে আসে।
এ নিয়ে পুরান ঢাকার বংশালের ব্যবসায়ী ও ফয়সাল এন্টারপ্রাইজ আয়রন অ্যান্ড স্টিল মার্চেন্টের পরিচালক আরশাদ হোসেন আসাদ বলেন, কঠোর লকডাউনের সময় দোকান বন্ধ ছিল। এরপর দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখি সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে নাকি রডের দাম বেড়েছে। তবে লকডাউনের সময়তো কোনো বিক্রি ছিল না, তাহলে সেসময় কেন বাড়লো? এখনো বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। আমরা সাধারণ বিক্রেতা। উৎপাদন পর্যায়ের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
দাম বেড়েছে ইট, খোয়া, পাথর, বালু ও সিমেন্টেরও। এক হাজার ভালো মানের ইট বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকার মধ্যে, দ্বিতীয় গ্রেডের ইট বিক্রি হচ্ছে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকায়। অথচ ভালো মানের ইট এর আগে সাড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যেই বিক্রি হয়েছে। মাস তিনেক আগে প্রতিব্যাগ সিমেন্ট ৩৯০ টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও এখন তা বেড়ে ৪৩০ থেকে ৪৭০ টাকা হয়েছে।
দাম বেড়েছে পাথরেরও। প্রায় ২৫ টাকা বেড়ে ভোলাগঞ্জের প্রতি ঘনফুট পাথর বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়ে ভারতীয় কালোপাথর বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকায়, আর দুবাইয়ের পাথর ১৮৫ টাকায়। বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের বালু। বর্তমানে প্রায় তিন টাকা বেড়ে প্রতিঘন ফুট সাদা বালু বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকা, প্রায় পাঁচ টাকা বেড়ে সিলেটের লাল বালু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়।
পাথর-বালু, ইট, সিমেন্টের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী ও আল্লাহর দান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমিনুল হক বলেন, ইট পোড়ানোর সময় দাম কম থাকে। বৃষ্টি হলে ইটের দাম বেড়ে যায়। এখন পরিবহন খরচ বেড়েছে, এ কারণে বালু-পাথর আনতে বাড়তি খরচ হচ্ছে। এছাড়া করোনার কারণে পাথর আমদানিতে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। শুনেছি বিশ্ববাজারে সিমেন্টের দাম বেশি, এ কারণে দেশে বেড়েছে। এর চেয়ে বাড়তি কিছু আর বলতে পারবো না। তবে দাম কমলে আমরাও দাম কমিয়ে বিক্রি করি।
এদিকে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব পড়ে আবাসন ব্যবসায়। লোকসান কাটাতে অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নমানের বালু, রডের ব্যবহার করছেন। এতে মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। মান কমে যাওয়ায় ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে ভালো নামিদামি আবাসন প্রতিষ্ঠান ফ্ল্যাটের দাম না কমালেও এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তার (ক্রেতার) ওপর। বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে নতুন ফ্ল্যাট, লোকসান গুনতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। অন্যদিকে সবকিছুর বাড়তি দামের কারণে এখনো প্রস্তুত ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছেন না বিক্রেতারা। ক্রেতা এলেও দরদামে বিক্রি না হওয়া এসব ফ্ল্যাটের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের মতো। অনগোয়িং ফ্লাটের সংখ্যা ধরলে এ হিসাব আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
এ নিয়ে কথা হয় রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বছর অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের কারণে ভালো বিক্রি হয়েছে। লকডাউনের কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা ফ্ল্যাট কিনতে পারছেন না। একই কারণে আবারও আবাসন খাতে বিক্রি কমে গেছে। তাছাড়া নির্মাণসামগ্রীর প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নাজুক অবস্থায় রয়েছে ব্যবসা। একাধিক রেডি ও অনগোয়িং ফ্ল্যাট অবিক্রিত রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আবাসন ব্যবসায় বহুমুখী সংকট তৈরি হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) অর্ধেক জনবল দিয়ে কাজ চলায় প্ল্যান পাসে সমস্যা হচ্ছে। সেখানে দীর্ঘসময় ধরে ফাইল আটকে থাকছে। এতে বড় ধরনের বাধা তৈরি হচ্ছে, কাজ এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। এখন নতুন সংকট নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে। এসব সামগ্রীর দাম কমে এলে ফ্ল্যাটের দামও কমে আসবে। এমনটা না হলে আবাসনে মৌলিক চাহিদা পূরণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।