এক দশকে বইমেলায় বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১১৪৩ বই

ফানাম নিউজ
  ০৭ মার্চ ২০২২, ২৩:২০

অমর একুশে বইমেলা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও প্রাণের মেলা। সময়ের পরিক্রমায় মেলা যেমন হয়ে উঠেছে লেখক পাঠক, প্রকাশকসহ দর্শনার্থীদের মিলনমেলা, তেমনি মেলার পরিসরও বেড়েছে বহুগুণ। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হওয়া বইমেলা প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। দুই বছর ধরে বইমেলায় বইও এসেছে আগের তুলনায় বেশি। তবে দেখা যাচ্ছে সব ধরনের বই কেনার প্রতি আগ্রহ কমেছে পাঠকদের। সেই সঙ্গে প্রকাশকদের ব্যবসায়িক চিন্তার ফলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে হারে বাড়ছে না মানসম্মত বই।

বাংলা একাডেমির জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই বের হয় সবচেয়ে বেশি। সে বছর শুধু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বের হয় ১৪৪টি বই। মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৫২টি। ২০২১ সালে করোনা মহামারির মধ্যে বইমেলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৫১টি আর মুক্তিযুদ্ধের বই বেরিয়েছিল ৮৪টি। ২০২২ সালে এ পর্যন্ত (৭ মার্চ) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৬৪টি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৭৫টি বই এসেছে।

বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বইমেলায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই এসেছে মোট ১ হাজার ১৪৩টি।

এর মাঝে ২০১৯ সালে বই এসেছে ১১০টি, ২০১৮ সালে ৯১টি, ২০১৭ সালে ৯৭টি, ২০১৬ সালে ১০১টি, ২০১৫ সালে ৫৩টি, ২০১৪ সালে ৫৭টি, ২০১৩ সালে ৬৪টি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বই প্রকাশের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ।

২০২০ সাল থেকে দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় বের হওয়া বই পাঠকের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেননি প্রকাশকরা। এবারের বইমেলা করোনার কারণে দেরিতে শুরু হলেও পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। এতে পাঠক ও দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে বইগুলো পাঠকের কাছে পৌঁছানোর একটি সুযোগ তৈরি হয়।

এ বিষয়ে মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এ সময়ে আমরা বইমেলা করতে পারছি, পাঠকের কাছে এবং প্রকাশনা শিল্পে এটি একটি বড় ঘটনা। আমরা তার জন্মদিনে ঐতিহাসিক এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা করছি এবং তাকে নিয়ে গত দুই বছর প্রচুর প্রকাশনা হয়েছে। সেই প্রকাশনা আমরা করোনার কারণে পাঠকের কাছে দিতে পারিনি, দেখাতে পারিনি। কিন্তু এবার সুযোগ হয়েছে পাঠকের কাছে তা পৌঁছানোর। তাকে নিয়ে যে বিশাল প্রকাশনা হয়েছে পাঠক তা দেখতে পেয়েছেন, আরও পাবেন। বঙ্গবন্ধুকে এই মেলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম আরও বেশি জানতে পারছে।

মুনতাসীর মামুনের লেখা বঙ্গবন্ধুর জীবন: মুক্তির অভিযাত্রা (৫ম খণ্ড), দিলীপ চক্রবর্তীর সক্রেটিস থেকে কার্ল মার্কস, মহাত্মা গান্ধী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: তাঁদের স্মরণীয় বিচার কথা, সোহরাব হাসানের আগরতলায় শেখ মুজিবের গোপন সফর, ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর’সহ অনেক ভালো লেখকের বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই এসেছে। এর বাইরে আরও অনেকেই এ বিষয়ে লিখেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধের নামে বই লিখে কাটতি বাড়াতে কিংবা পরিচিত বাড়াতেই লিখে থাকেন। মানের বিবেচনা বা তথ্যের ক্ষেত্রে থাকে নানা ভুল।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি ও লেখক মিনার মনসুর তার বক্তৃতায় বলেন, আমরা যখন কোনো বই কিনবো তখন আমরা লেখাগুলো বাছাই করি। এবছর বাছাই করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, ৮০ ভাগ বইয়েরই কোনো মূল্য থাকে না। ২০ ভাগ বই আমরা বাছাই করি। সেখানেও ১৫ ভাগ বই কপি করা থাকে। গবেষণার কাজ হচ্ছে না আমাদের দেশে। গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ হয় না। ভালো গবেষণামূলক বইয়ের নাম বলতে বললে ১০টি বইয়ের নামও বলতে পারবো না। বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লেখা বই অথচ সেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট সূত্র নেই, এমনও বইও খুঁজে পাওয়া যায়।

অনেক প্রকাশকও বলছেন একই কথা।

এ বিষয়ে অনন্যা’র প্রকাশক মনিরুল হক বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানুক। যত বেশি ভালো বই বের হবে তত ভালো। তবে ভুল বই না থাকাই ভালো। কিছু আছে খুবই নিম্নমানের। কিন্তু ঐগুলোই নাকি কীভাবে কি বিক্রি হয়, স্কুল কলেজে দিয়ে দেয়। ৩০০ টাকা দাম, ৫০ টাকায় বিক্রি করে দেয়। এত নিম্নমানের, বাজে বই। এমন বহু বই আছে মেলায়। আপনারা পড়লে বুঝতে পারবেন। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার যদি উদ্যোগ নিতো বা বাংলা একাডেমি এটা করতে পারতো যে, আমাদের পান্ডুলিপি না দেখিয়ে এ ধরনের বই প্রকাশ করতে পারবে না। তাহলে ভালো হতো। তাহলে অনেক বই বের হতো না। দরকার তো নেই এত বই। একদম নির্ভুল বই ১০টাই যথেষ্ট। আমি সেটাই মনে করি।

তবে প্রতি বছরই মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা বা মৌলিক বই বের হয় বইমেলাকে ঘিরে। এসব বইয়ের চাহিদাও রয়েছে বেশ। অনন্যা’র প্রকাশক মনিরুল হক বলেন, আমরা চেষ্টা করছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মৌলিক, নির্ভরযোগ্য ও ভালো বই বের করার। আমাদের লেখক তালিকাতেও সেসব লেখকদেরই রেখেছি। আমাদের পাঠকদেরও ব্যাপক চাহিদা আছে। আমাদের বই বিক্রিও হচ্ছে।

এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করা লেখক মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কর্নার বা বঙ্গবন্ধু কর্নার করার উদ্দেশ্য নিয়ে বইগুলো এখন বের হচ্ছে। এখানে ব্যবসায়ীক একটি উদ্দেশ্য থাকে। ফলে দুই-তিনটা জায়গা থেকে কয়েকটা ফর্মা মিলিয়ে কাজ করে ফেলছে। এ কারণে নির্ভুল ও নিভর্রযোগ্য বই না পাওয়া বা কোনো কোনো বইয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। এতে করে গবেষণা করে যারা বইগুলো লিখছে তাদের বইগুলো আর সেভাবে প্রভাব ফেলে না অনেক সময়। আগাছা চারদিকে বাড়লে আসল গাছটা হারিয়ে যায়। এই বইগুলোর কারণে পাঠকরা ভুল শিখবে। এক্ষেত্রে প্রকাশকদেরও একটা দায়িত্ব আছে। তারা শুধু প্রকাশকই নয়, একটি সমাজ গড়ারও কারিগর।

তিনি আরও বলেন, এত প্রকাশনা আমরা আগে কখনো দেখিনি। বাজারে তো এত প্রকাশনা নেই। ভালো বই নজরে এখন পড়ে না। তাই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশক ও পাঠক যারা কিনবেন, তারা যদি সচেতন না হন, তাহলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।

সূত্র: জাগো নিউজ