বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পথনির্দেশ করে সাত মার্চের ভাষণ

ফানাম নিউজ
  ০৭ মার্চ ২০২২, ০৭:৫৭

ঐতিহাসিক সাত মার্চ আজ। এই দিনে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে। মূলত প্রেসিডেন্ট লিংকনের গ্যাটিসবার্গ ভাষণের খ্যাতিকেও ছাড়িয়ে গেছে এই ভাষণ। এই ভাষণটি শুধু বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতায় উদ্দীপ্ত করেনি, সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষকে তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষায় উদ্দীপ্ত করেছে। 

এখন এই ভাষণটি ক্ষুদ্রাকার মহাকাব্যে পরিণত হয়েছে। এই ভাষণটির জন্যই বঙ্গবন্ধু আখ্যা পেয়েছেন ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা রাজনীতির কবি। এই ভাষণে উদ্দীপ্ত বাংলার তরুণ-যুবকরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল গান্ধী ও সুভাষ বসুর রাজনৈতিক কৌশলের মিশ্রণ। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। গান্ধী তার আন্দোলনকে সফল করতে পারেননি। কারণ সশস্ত্র সংগ্রামে তার বিশ্বাস ছিল না। তিনি আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেখানে তার আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন সংঘবদ্ধ মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সামনে পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যবাদও দাঁড়াতে পারে না। এ কথা তিনি ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বলেছিলেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনাদের হাতে কত মারণাস্ত্র! কিন্তু ভিয়েতনামের মানুষের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের সামনে আপনাদের পরাজিত হতে হলো’।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরও সাতই মার্চের ভাষণ বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের কাছে এক নতুন পথনির্দেশ করেছে। সত্তরের দশকের শেষদিকে ওয়ারশোতে বিশ্ব শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে হো-চি-মিন, ফিদেল কাস্ত্রো এবং আরও অনেক বিশ্বনেতার ছবির পাশে বঙ্গবন্ধুর ছবিও স্থান পেয়েছিল। আমি যখন লন্ডনে, তখন এখানকার ট্রাফালগার স্কোয়ারে আফ্রিকানদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সম্মেলনে এক আফ্রিকান কবি বঙ্গবন্ধুর নামে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। আমি সেই গানটি সংগ্রহ করে আমাদের ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলাম। আমার প্রয়াত বন্ধু ডা. হারিছ আলী এই কবিতাটি অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদটিও ‘বাংলার ডাকে’ প্রকাশিত হয়েছিল।

সাতই মার্চের ভাষণ আজ গ্যাটিসবার্গে লিংকনের ভাষণের মতো মানুষের মনে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। যেখানে যত নির্যাতন শুরু হয়, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সেখানে নির্যাতিত মানুষের হাতে অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য বঙ্গবন্ধুর নামটিকে নির্যাতনকারীরা ভয় পায়। বাংলাদেশে যখন তাকে হত্যা করে সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হাতে নেয়, তখন বঙ্গবন্ধুর নাম দেশ থেকে একেবারে লোপাট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এ কথাটিকেও মুছে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রও শেখ মুজিবের ছবি ছাপার সাহস দেখায়নি। আজ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও তার নামে বই ছাপানোর কী প্রতিযোগিতা! এখন দেশের সবাই আওয়ামী লীগার! সবাই মুজিবের সৈনিক!

অন্যদিকে, সেই মহাপুরুষকে আজ দেবতা বানানো হয়েছে। কিন্তু তার আদর্শ কোথাও নেই। সাতই মার্চ এলে ঘরে ঘরে তার বাণীটি বাজে। অতীতের কলের গানের রেকর্ডর মতো। দেশের নির্যাতিত মানুষ এখনো এই ভাষণ শুনে উদ্দীপ্ত হয়। এই ভাষণের মধ্যে তারা মুক্তির নবদিগন্ত দেখতে পায়। ভবিষ্যতে এই ভাষণই বাঙালিকে আবার সংঘবদ্ধ করবে এবং অত্যাচারীদের কবল থেকে শুধু তার দেশকে নয়, তার দলকেও মুক্ত করবে।

আজ দেশের একদল রাজনীতিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যতই পলাশীর যুদ্ধের মতো পরিণাম ডেকে আনতে চান, তাদের ষড়যন্ত্র সফল হবে না। সাত মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত জাতি আবার সংগ্রাম করবে। আবার সাম্রাজ্যবাদ ও দেশের ভবিষ্যৎ ভ্রান্ত শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে এবং জয়ী হবে।

বঙ্গবন্ধুকে সাম্রাজ্যবাদীরা এবং তাদের সহযোগী শক্তি এতই ভয় করে যে, তাকে ‘দেবতার আসনে’ বসিয়ে তার আদর্শ মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। এ কথা আগেই বলেছি। কিন্তু জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আবার মাথা তুলছে। পঞ্চাশের দশকে নেহরু, নাসের ও টিটোর নেতৃত্বে এই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তৈরি হয় এবং মার্কিন ও রুশ এই দুই মহাশক্তির প্রতাপ থেকে ক্ষুদ্র ও সদ্যস্বাধীন দেশগুলোর স্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধান করে। নেহরু ও নাসেরের মৃত্যুর পর এই জোটের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী ও মিসরের আনোয়ার সাদাত। মার্শাল টিটো কিছুদিন পর মারা যান। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তার দেশটিকে দুই টুকরো করে ফেলে।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন তা আবার পুনর্গঠিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আবার বিভিন্ন ভাষায় শোনা যাচ্ছে। তিনি কবরে শুয়ে বিশ্বের নির্যাতিত মানুষকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ল্যাটিন আমেরিকার জনজাগরণে তার এই ভাষণটি শোনা গেছে। লিংকনের ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পাশাপাশি বাজতে শোনা গেছে। এতেই প্রমাণ পাওয়া যায়, সাতই মার্চের ভাষণ বহু আগেই আটলান্টিক পেরিয়ে বিশ্বের ওপারেও পৌঁছেছে।

লিংকনকে হত্যার পর তার নামে অনেক অপবাদ ছড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তা টেকেনি। তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও তার বিরুদ্ধে নানা অপবাদ ছড়ানো হয়েছিল। তার মধ্যে একটা মিথ্যা, তিনি সাতই মার্চের ভাষণের শেষে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলেছিলেন। এই মিথ্যাচার বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন প্রধান হাবিবুর রহমান শেলী করেছেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার যখন বই লিখে বললেন, বঙ্গবন্ধু ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলেছিলেন, তখন দেশে দারুণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। একে খন্দকার পরে তার ভুল স্বীকার করে বলেছেন, ষড়যন্ত্রকারীরা এটি করেছিল। তিনি জাতির কাছে এই ভুলের জন্য ক্ষমা চান। অন্যদিকে, বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী তার বিভ্রান্তিকর উক্তি সম্পর্কে নীরব হয়ে যান এবং কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণের ফলে ভুল স্বীকারের সময় পাননি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শকে ঘোলাটে করার চেষ্টা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু জাতিকে যে সংবিধান দিয়ে গিয়েছিলেন তাকে সামরিক শাসকরা কেটেকুটে বিকৃত করেছিলেন। এখন দেশের সব দলই সেই সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। এ দাবির ভিত্তিতে দেশে শক্তিশালী আন্দোলন হবে, তাতে সন্দেহ নেই।

দেশে এখন আওয়ামী লীগের শাসন বিরাজিত। তাতে বঙ্গবন্ধুর শাসন বিরাজিত, একথা বলা যায় না। আওয়ামী লীগ স্বধর্মভ্রষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে অনেক পিছিয়ে এসেছে। ফলে আবার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। এই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নয়। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে যে দেশ গঠন করতে চেয়েছিলেন, সেই লক্ষ্য থেকে আওয়ামী লীগ বহু দূরে সরে গেছে। তারা এখন ধনতান্ত্রিক রাজনীতি ও অর্থনীতির অনুসারী। এর ফলে দেশে একশ্রেণির ভুঁইফোঁড় নব্যধনীর আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের অত্যাচার ও লুটপাটে দেশের মানুষ অস্থির। আওয়ামী লীগ যদি এই লুটেরাদের হাত থেকে মুক্ত না হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে কী হবে, তা বলা মুশকিল।

সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একা নির্বাচনযুদ্ধে জয়ী হয়েছে। আগামী নির্বাচনে তারা তা পারবে কি? ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস প্রমুখ নেতা হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার জন্য তৎপর। তাদের প্রোপাগান্ডা অত্যন্ত শক্তিশালী। এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সঠিক স্থানে দাঁড়াতে পারছে না। আওয়ামী লীগকে যদি আবার গণমানুষের সংগঠন হতে হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ফিরে যেতে হবে। কীভাবে যেতে হবে তার নির্দেশ সাত মার্চের ভাষণে রয়েছে, যেখানে সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে তিনি বলেছেন, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো’। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন তিনি।

আজ আবার সাতই মার্চের ভাষণ সাধারণ মানুষকে উদ্দীপ্ত করুক। সাতই মার্চকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা দ্বারা বরণ না করে একে অতীতের সংগ্রামী ঐতিহ্য দ্বারা বরণ করা উচিত। আওয়ামী লীগ সরকার যদি সাতই মার্চের ভাষণের পথনির্দেশকে আজ যথার্থভাবে অনুসরণ করে, তাহলে তারাও দেশ ও দলকে রক্ষার উপায় খুঁজে পাবেন।