শিরোনাম
এবছর গ্রীষ্মে ইউরোপ ও চীনের বিশাল এলাকায় তাপমাত্রার চরমে উঠেছিল। গত ৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছিল ইউরোপ। আর চীন গত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে।
আফ্রিকায়ও খরার কারণে লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মরার ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলেও দীর্ঘদিন ধরেই পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। চরম উষ্ণ ও শুষ্ক মৌসুম দিন দিন যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এমন প্রেক্ষিতে শনিবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে ২০২২ সালই ইতিহাসের সবচেয়ে শুষ্ক বছর কিনা সে ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা হয়েছে।
চলতি বছরে পৃথিবী কতটা শুষ্ক ছিল?
শুষ্কতা পরিমাপের জন্য বিজ্ঞানীরা যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তার এক হলো- উপগ্রহের ছবির সাহায্যে মাটির আর্দ্রতা পরিমাপ করা। ওই পদ্ধতিতে গত তিন মাসের শুষ্কতার সঙ্গে এই শতাব্দীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত গড় শুষ্কতার তুলনা করে সাম্প্রতিক চরম আবহাওয়ার একটি চিত্র হাজির করার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
এতে দেখা গেছে, ইউরোপের বেশিরভাগ অংশে এবারের গ্রীষ্মে ২০০১ থেকে ২০১৬ সালের গড়ের তুলনায় বেশি শুষ্ক পরিস্থিতি দেখা গেছে। চীনের পশ্চিম অংশও তীব্র শুষ্ক পরিস্থিতি দেখছে, অনেক এলাকা ভয়াবহ খরায় ভুগছে। সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন আফ্রিকার কিছু অংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রও গুরুতর শুষ্ক পরিস্থিতি পার করছে।
৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে ইউরোপ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশগত কর্মসূচি কোপার্নিকাসের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপের এবারের গ্রীষ্মের খরা সম্ভবত মহাদেশটির ৫০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। আগস্টের শেষভাগে এই শুষ্ক মৌসুমের ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ে’ ইউরোপের প্রায় অর্ধেক এলকাতেই ‘মাটির আর্দ্রতার ঘাটতি’ দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইউরোপ আরও বেশি ও লাগাতার খরা দেখতে পাবে। আর চলতি বছরের শুষ্ক পরিস্থিতি কৃষি, পরিবহন ও জ্বালানি উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে। ইউরোপের অন্যতম প্রধান নদী ও মাল পরিবহনের রুট রাইনের পানি চলতি গ্রীষ্মে এতটাই নেমে গেছে, যে জাহাজ চলাচলে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি হয়েছে।
জুন থেকে আগস্ট সবচেয়ে উষ্ণ তিন মাস হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং আগস্টে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক প্রতিবেদনে আরও অন্তত তিন মাস ‘গরম ও শুষ্ক’ দিন থাকবে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপ আগেও শুষ্ক মওসুম দেখেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি গ্রীষ্মকাল ক্রমাগত উষ্ণ হতে দেখা যাচ্ছে।
পোস্টড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইম্প্যাক্ট রিসার্চের ড. ফ্রেড হাটেরমান বলেছেন, ‘টানা ৫ বছর খরা হয়েছে, এই বছর ইউরোপজুড়ে যে খরা, তা কয়েকশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক। কেবল কম বৃষ্টিই নয়, দিন দিন পরিবেশ উষ্ণ হয়ে উঠছে, যে কারণে সবমিলিয়ে মাটির আর্দ্রতা কমছে’।
চীনে একইসঙ্গে খরা ও বন্যা
এবারের গ্রীষ্মে চীনে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ চলেছে। চীনের আবহাওয়া বিষয়ক কর্তৃপক্ষ বলেছে, ১৯৬০ সালে আবহাওয়ার রেকর্ড রাখা শুরু করার পর থেকে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ছিল এই তাপপ্রবাহ।
তীব্র গরম এবং বৃষ্টিপাতের মারাত্মক ঘাটতির ফলে চীনের সবচেয়ে বড় নদী ইয়াংসি শুকিয়ে যাচ্ছে। চীনের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, আগস্টে নদীটির আশেপাশের এলাকায় স্বাভাবিকের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
দেশটির দক্ষিণের বিশাল অংশ যখন খরায় খাবি খাচ্ছে, তখন উত্তরে তুমুল বৃষ্টিপাত নিয়ে এসেছে বন্যা। উত্তর চীনের লিয়াও নদীর পানির স্তর ১৯৬১ সালের পর এবারই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। দেশজুড়ে ২০১২ সাল থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বলে চীনের বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণায় বলা হয়েছে।
জুলাইয়ে চীন সরকার ৮টি খরা সতর্কতা ও ১৩ হাজারের বেশি বৃষ্টি সতর্কতা জারি করেছিল। ২০১৯ সালের একই সময়ে দেশটি ২৮টির বেশি খরা সতর্কতা ও ১০ হাজার তীব্র বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করেছিল।
আফ্রিকায় খরার ফলে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি
খরা পরিস্থিতি ইথিওপিয়ার পূর্বাঞ্চল, কেনিয়ার উত্তরাঞ্চল ও সোমালিয়ার ২২ লাখ মানুষকে অনাহারের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। ব্রিটিশ দাব্য সংস্থা অক্সফাম জানিয়েছে, ‘আফ্রিকা মহাদেশের ওই অংশে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি তিন বছর ধরে কম বৃষ্টিপাত হচ্ছ ‘।
সোমালিয়ায় মার্চ থেকে মে মৌসুমে গত ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ডিআর কঙ্গো ও উগান্ডার বিশাল অংশও গড়ের তুলনায় বেশি শুষ্ক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ সুদান, মৌরিতানিয়া ও সেনেগালের মতো মহাদেশটির কিছু কিছু দেশে তীব্র বন্যা হচ্ছে।
আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের অনেক অংশ এখন গড়ের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত দেখছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত খরা ও বন্যার পরিমাণ ১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ সালের তুলনায় যথ্রাক্রমে তিন ও দশগুণ বেশি হয়েছে বলে ২০২১ সালে দেওয়া বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের খরা পরিস্থিতি
বছরের পর বছর ধরে শুষ্ক ও গরম আবহাওয়া চলছে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে। সেখানে খরা পরিস্থিতি দিন দিন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এক হাজার ২০০ বছরের মধ্যে গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে তীব্র খরা পরিস্থিতি দেখা গেছে। এবারের গ্রীষ্মেও তীব্র গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ার ফলে বেশ কয়েকটি রাজ্যে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে, জলাধারগুলোর পানির স্তর নেমে গেছে।
আরিজোনা ও ইউটাহজুড়ে বিস্তৃত যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাধার লেক পাওয়েলের পানির স্তর ১৯৬০ এর দিকে পানি ভর্তি করার পর এবারই সর্বনিম্ন স্তরে আছে বলে জানিয়েছে নাসা।
জলবায়ু সংক্রান্ত একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে সামনের দশকগুলোতেও গড়ের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টিপাত হবে।