শিরোনাম
ইভ্যালিকাণ্ডে ই-কমার্স খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অর্ডার যেমন কমছে, তেমনই অগ্রিম পেমেন্টের সংখ্যাও কমেছে। বেড়েছে ক্যাশ অন ডেলিভারি (সিওডি)। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আস্থার সংকটের কারণে এমনটা হয়েছে। এই সংকট কাটতে সময় লাগবে। ৬ মাস থেকে এক বছরও লেগে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান,দেশে করোনা মহামারির সময়ে ই-কমার্সের বিশাল উত্থান হয়েছে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ। যদিও অনেকে মনে করেন, এই প্রবৃদ্ধি ঢাকাকেন্দ্রিক। যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রোসারিনির্ভর তারা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলেও অন্যদের অবস্থা খারাপ। বিশেষ করে যারা হাই ভ্যালু (দামি) পণ্য বিক্রি করেন তাদের অবস্থা অনেকটা শোচনীয়।
ই-কমার্স উদ্যোক্তারা বলছেন, পণ্য উৎপাদক, সাপ্লাইয়ার ও আমদানিকারকরা তাদের বাকিতে পণ্য দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। নগদে পণ্য কিনে আগের ভলিউমে ব্যবসা করা সম্ভব না হওয়ায় তাদের পরিচলন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তারা অগ্রিম দামও (নির্দিষ্ট শতাংশ হারে) সেই হারে পাচ্ছেন না। ভরসা করতে হচ্ছে ক্যাশ অন ডেলিভারির (সিওডি)ওপরে। সব মিলিয়ে পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়ছে পুরো ই-কমার্স সেবায়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ই-কমার্স উদ্যোক্তা ফাহিম মাসরুর বলেন, ‘বিশাল প্রভাব পড়েছে ই-কমার্সে। ছোটদের ওপরে প্রভাবটা বেশি। বড় তথা মেইন স্ট্রিমের ই-কমার্স, যাদের গ্রাহক বেশি, তাদের খুব বেশি সমস্যা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘ই-কমার্সে মানুষের আস্থা কমেছে। নতুন গ্রাহক আসছে না। পুরনো গ্রাহকরাও সরে যাচ্ছে। তারা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। এই প্রবণতা এ খাতের জন্য শুভ নয়।’
তিনি জানান, সার্বিকভাবে ই-কমার্সে গত কিছুদিনে ২০-২৫ শতাংশ অর্ডার কমে গেছে। অগ্রিম নিতে পারছেন না অনেকে। পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিগুলো নগদ টাকা দিতে বেশি দেরি করছে। অপরদিকে সিওডি বেড়ে গেছে। ফলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পরিচলন ব্যয় বেড়েছে।
ফাহিম মাসরুর আশঙ্কা করেন— দীর্ঘমেয়াদে সরকার যদি ই-কমার্সে কমপ্লায়েন্স ইস্যু চাপিয়ে দেয়, তাহলে ছোট উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ এলে বড় উদ্যোক্তারা পার পেলেও ছোটরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
তিনি সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ই-কমার্স স্ক্যামে যাদের নাম আসছে, তাদের আইনের আওতায় উচিত। যারা ইভ্যালির মডেলে ব্যবসা করছে, তাদের সম্পদ জব্দ করা উচিত। তাহলে অন্যরা সতর্ক হয়ে যাবে। গ্রাহকরা ক্ষতির মুখে পড়বে না।’
গ্যাজেটসনির্ভর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সেলেক্সট্রা শপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিব আরাফাত বলেন, ‘ই-কমার্স খাতটা এলোমেলো হয়ে গেছে। গুছিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে।’ সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের নানামুখী উদ্যোগ এই খাতের সংকট কাটাতে সাহায্য করবে বলে তিনি মনে করেন।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রিয়শপ ডট কমের প্রধান নির্বাহী আশিকুল আলম খাঁন বলেন, ‘বিশাল চাপে পড়ে গেছে দেশের ই-কমার্স খাত। সাপ্লাইয়াররা এখন বাকিতে আমাদের পণ্য দিতে চান না। নগদ টাকা দিয়ে আমাদের পণ্য কিনতে হচ্ছে। এতে করে আমাদের পরিচলন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যা মোট বিক্রি তার ২০ শতাংশ আসতো প্রি-পেইড বা অগ্রিম হিসেবে। এখন তা নেমে গেছে ৫ শতাংশে। ৯৫ শতাংশ লেনদেন এখন ক্যাশ অন ডেলিভারিতে হচ্ছে। পরিচলন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার এটাও একটা কারণ। গ্রোসারির (নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য) কারণে প্রিয়শপের গ্রোথ এখনও ঠিক আছে। গ্রোসারি বাদ দিলে বাজার এখন নিম্নগামী বলা যায়।’
তিনি জানান, ইভ্যালি-কাণ্ডে ই-কমার্স খাত প্রায় ৫০ শতাংশ বাজার হারিয়েছে। প্রিয়শপের অর্ডারও কমেছে বলে তিনি জানান।
পিকাবো ডট কমের প্রধান নির্বাহী মরিন তালুকদার বলেন, ‘যে প্রভাব পড়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। করোনার প্রকোপ কমছে, এই সময়ে ই-কমার্স খাত টেকসই মডেলের দিকে যাবে বলে আশা করেছিলাম আমরা। কিন্তু অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো এই খাতের।’ তিনি জানান, পিকাবোর ১৫ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে, গত মাসের তুলনায়, সব মিলিয়ে আরও বেশি। আস্থাহীনতার কারণে এমনটা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা হাই ভ্যালু (দামি) পণ্য বিক্রি করি, তাদের সমস্যাটা অন্যদের তুলনায় বেশিই। বেশিরভাগ ক্রেতাই সিওডি-তে (ক্যাশ অন ডেলিভারি) আগ্রহী।’
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-ক্যাব (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) এ বিষয়ে কী মনে করছে জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ‘এই খাতে বিশাল একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ক্রেতাদের মনে আস্থার একটা সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ইভ্যালির দেখাদেখি অনেকে এটাকে রোল মডেল ভেবে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এটাই সমস্যা তৈরি করেছে।’ তিনি জানান, ই-ক্যাব ২০১৯ সালে এস্ক্রো সার্ভিসের (টাকা গেটওয়েতে থাকবে। ক্রেতা পণ্য বুঝে পেলে বিক্রেতা টাকা পাবে) পরামর্শ দিয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর) তৈরির পরামর্শ দিয়েছে। তমাল জানান, ইভ্যালি বিনিয়োগকারী খুঁজতে গিয়েই এসব করেছে বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু সেটাও তারা পায়নি। তারা বিশাল ডিসকাউন্ট মডেল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। দ্রুত বড় হতে চেয়েছে। বের হতে পারলে মডেলটি সাসটেইন করতে পারতো। ইভ্যালি যা করেছে, তা তাদের করা মোটেও উচিত হয়নি। তিনি মনে করেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ম্যানুয়াল পদ্ধতি ছেড়ে যতদিন না পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর হবে, ততদিন এসব সমস্যা যাবে না।
স্থগিত হচ্ছে চারটি ই-কমার্সের সদস্যপদ
দেশের শীর্ষস্থানীয় চার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত করবে ই-ক্যাব। চলতি সপ্তাহেই ই-ক্যাব থেকে এই ঘোষণা আসতে পারে বলে ই-ক্যাব সূত্রে জানা গেছে।