শিরোনাম
মহামারি করোনাভাইরাসের চলমান তৃতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত বেশি হলেও মৃত্যু অপেক্ষাকৃত কম। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভুগিয়েছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, এবার ওমিক্রন। তবে কমেছে হাসপাতালে ভর্তির প্রবণতা। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটির দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে কালেভদ্রে। নেই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া। সব বাধা মাড়িয়ে টিকাকরণ জোরদারসহ সরকারের নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপে মহামারি রুখতে অনেকটা সফল বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় প্রায় তিন বছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে করোনা পরীক্ষার পর্যাপ্ত সংখ্যক ল্যাবরেটরি স্থাপন, হাসপাতালে রোগীদের সুচিকিৎসার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (পর্যাপ্ত বেড, আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ইত্যাদি) স্থাপন করা হয়েছে। সরবরাহ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। প্রতিষেধক হিসেবে টিকাদানের ব্যবস্থাসহ সহায়ক সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ায় মৃত্যু কম হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে করোনায় মোট ৯ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৪টি নমুনা পরীক্ষায় দুই লাখ ১৩ হাজার ২৯৪ জন রোগী শনাক্ত হয়। যাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৩২২ জনের। যারা মারা গেছেন তারা বিভিন্ন কো-মরবিডিটিজনিত (উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগ) রোগ-ব্যাধিতে ভুগছিলেন। মৃতদের মধ্যে ৭৩ শতাংশই করোনা প্রতিষেধক টিকা নেননি।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণের শুরুর দিকে নমুনা পরীক্ষার জন্য শুধু সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একমাত্র আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিই ভরসা ছিল। করোনা রোগটি নতুন হওয়ায় এবং এ রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য না থাকায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল কোনোরকমে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ছিল মাস্ক সংকট। ছিল না অতি প্রয়োজনীয় হাইফ্লো অক্সিজেন। হাসপাতালের শয্যার পাশে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন থাকা অত্যাবশ্যক হলেও তা ছিল অপ্রতুল। করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে শত শত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হন। মৃত্যুবরণ করেন অনেকে। আতঙ্কে করোনারোগীর মৃত্যুর পর স্বজনরা মরদেহ ফেলে পালানোর ঘটনাও ঘটে।
দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত ও ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যু হয়। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ১ কোটি ২৫ লাখ ৬৮ হাজার ২২৬টি নমুনা পরীক্ষায় ১৮ লাখ ২৪ হাজার ১৮০ জন করোনারোগী শনাক্ত হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৮ হাজার ৪৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৮ হাজার ১৭৩ (৬৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ) ও নারী ১০ হাজার ২৮৮ জন (৩৬ দশমিক ১৫ শতাংশ)। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চসংখ্যক (ঢাকা ১২ হাজার ৪৬৪ ও চট্টগ্রাম ৫ হাজার ৭৬১) রোগীর মৃত্যু হয়েছে এখন পর্যন্ত।
করোনাকালে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন হার যখন ছিল
২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৫ আগস্ট সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫৭ হাজার ২৯৭টি নমুনা সংগ্রহ ও ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল সর্বনিম্ন ৩২০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২০২১ সালের ৫ আগস্ট সর্বাধিক ৫৫ হাজার ২৮৪টি নমুনা পরীক্ষা ও সর্বনিম্ন নমুনা পরীক্ষা করা হয় ২০২০ সালের ২১ মার্চ। ২০২১ সালের ২৮ জুলাই সর্বাধিক ১৬ হাজার ২৩০ ও ২০২০ সালের ৩০ মার্চ একজন রোগী শনাক্ত হয়। ২০২১ সালের ৮ আগস্ট সর্বোচ্চসংখ্যক ১৬ হাজার ৬২৭ ও ২০২০ সালের ১ এপ্রিল একজন রোগী সুস্থ হয়। ২০২১ সালের ৫ ও ১০ আগস্ট দুদিন সর্বাধিক ২৬৪ জন করে মারা যায়। অন্যদিকে ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর করোনায় মৃত্যুহীন ছিল দেশ।
২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি নমুনা পরীক্ষার সংখ্যানুপাতে শনাক্তের হার সর্বোচ্চ ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও ২০২০ সালের ৩০ মার্চ সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ ছিল। ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর সুস্থতার হার সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ ও সর্বনিম্ন ২০২০ সালের ২ মে ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মৃত্যুহার সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ ও ২০২০ সালের ৪ জুলাই ছিল সর্বনিম্ন ১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে একাধিবার বলেন, মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত করছে বাংলাদেশ। শুরুর দিকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ রোগের সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় ভুলত্রুটি থাকলেও কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে করোনা মোকাবিলায় বিশ্বে হাতেগোনা যে কয়েকটি দেশ সফলতা দেখিয়েছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। করোনা মোকাবিলায় সফলতার জন্য দেশ অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
প্রথম দিকে করোনা মোকাবিলার পথটি মসৃণ ছিল না। প্রায় তিন বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় করোনা মোকাবিলায় শামিল হয়। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ায় একাধিকবার লকডাউন দেওয়া হয়। গঠিত হয় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিসহ একাধিক কমিটি। দ্রুত করোনা শনাক্তে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ল্যাবরেটরি স্থাপন, হাসপাতালে করোনা ডেডিকেটেড বেডের ব্যবস্থা, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ), হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য করোনার প্রতিষেধক টিকার ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া ঘরে বসে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য টেলিমেডিসিন পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩ কোটি ২৮ লাখ ৫৮ হাজার ২৯ জন টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছেন।
দেশে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। শুরুর দিকে শুধু ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা দেওয়া হচ্ছিল। পরবর্তীসময়ে মডার্না, ফাইজার, সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক টিকা দেওয়া হয়। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে টিকা দেওয়া হয়েছে ১৬ কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৯৪ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি দেশের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে সরকার দেশের জনগণের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা, আইসিইউ, এইচডিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, অক্সিজেন সিলিন্ডার, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের ব্যবস্থা করে।
তিনি জনান, বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ হাজার ৮৮০টি সাধারণ শয্যা, এক হাজার ২৭৪টি আইসিইউ শয্যা, ৭২৭টি কোভিড এইচডিইউ, ১১৯টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, ২৯ হাজার ২৫৮টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ২ হাজার ৩৫টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ২ হাজার ৩৪৮টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, গত তিন বছরে করোনা মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি পর্য়ায়ে ভালো প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সচেনতনতাও বেড়েছে। ফলে তৃতীয় ঢেউয়ে করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় কম হচ্ছে।
বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) সভাপতি এম এ মোবিন খান বলেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। গত তিন বছরে সারাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। শুরুর দিকে চিকিৎসা পদ্ধতি ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় করোনারোগীর মৃত্যু বেশি হলেও বর্তমানে আগের তুলনায় অনেক কম।
সূত্র: জাগো নিউজ