দ্রুত ছড়ানো অমিক্রনের উপসর্গের তীব্রতা কম

ফানাম নিউজ
  ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৩৪

করোনার নতুন ধরন অমিক্রন ছাড়াচ্ছে দ্রুত। করোনা সংক্রমণের আগের দুটি ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণের হার অনেক বেশি। তবে এবার সংক্রমিত ব্যক্তির উপসর্গের তীব্রতা কম বলছেন চিকিৎসক ও গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, করোনার ডেলটা ধরনের জায়গা নিচ্ছে অমিক্রন। এ ধরন শ্বাসযন্ত্রের ওপরের অংশে ছড়ায়, যা তুলনামূলক কম গুরুতর। তবে অমিক্রন বেশির ভাগ মানুষকে অল্প সময়ে দ্রুত সংক্রমিত করবে।

করোনার অমিক্রন ধরনটি দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা নতুন এ ধরন নিয়ে এখনো গবেষণা করছেন। তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, নতুন বছরের মধ্য জানুয়ারি নাগাদ দেশটিতে দৈনিক ৮০ হাজার নতুন রোগী পাওয়া গেছে, যা এ মহামারির যেকোনো সময়ের চেয়ে তিন গুণ। নতুন করে সংক্রমিত ব্যক্তিদের ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী করোনার অমিক্রন ধরন।

অমিক্রনের সংক্রমণ ও সুপ্তাবস্থা 

করোনার আটটি স্বীকৃত ধরনের মধ্যে অমিক্রন খুব দ্রুত ছড়ায়। গবেষকেরা বলছেন, এ ধরন ব্যক্তির শরীরে দ্রুত বিকশিত হয়। মানুষের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। করোনার অন্যান্য ধরনের চেয়ে অমিক্রনের সুপ্তাবস্থা (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) কম। ফলে তার উপসর্গ দ্রুত দেখা যায়। ভাইরাসের প্রথম সংস্পর্শে আসা ও প্রথম উপসর্গের মধ্যকার সময়কে বলে সুপ্তাবস্থা।

সিডিসির গবেষণা বলছে, মহামারির প্রথম দিকের করোনার ধরনটির সুপ্তাবস্থা ছিল গড়ে পাঁচ দিন। ভারতীয় বা ডেলটার সুপ্তাবস্থা চার দিন। অমিক্রনের সুপ্তাবস্থা তিন দিন। তার মানে, কেউ অমিক্রন ধরনের সংস্পর্শে এলে তার দ্রুত উপসর্গ দেখা দেবে।

অমিক্রনের ‘ভাইরাল লোড’ বেশি 

ভাইরাসবিদ্যার ভাষায়, শরীরে কোনো ভাইরাসের সংক্রমণের পর যে পরিমাণ ভাইরাস তৈরি হয়, তাকে ‘ভাইরাল লোড’ বলা হয়। যখন এই ‘ভাইরাল লোড’ বেশি হয়, তখন শরীর সবচেয়ে সংক্রমিত বলে ধরা হয়।

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় এসেছে, করোনার আলফা ও ডেলটা ধরনে কেউ আক্রান্ত হলে সংক্রমণের তিন দিন পর ব্যক্তির শরীরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ভাইরাস সংক্রমিত হতে দেখা যায়। এর ছয় দিন পর শরীর থেকে ভাইরাসটি চলে যায়।

এবার দেখা যাক, অমিক্রনের ক্ষেত্রে কী ঘটে। হার্ভার্ড টি এইচ চান স্কুল অব পাবলিক হেলথের একটি প্রাথমিক গবেষণা বলছে, ডেলটার চেয়ে অমিক্রনের সংক্রমণ কম সময়ে হয়। গড়ে ভাইরাল লোডও কম হয়। যাঁরা টিকা নিয়েছেন বা আগে একবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা (ইমিউনিটি) বেশি। ডেলটার সঙ্গে অমিক্রনের পার্থক্যটা এখানে বোঝা যায়।  

টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের ওপর করা সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব জেনেভার এক গবেষণা বলছে, অমিক্রন ও ডেলটা একই মাত্রার সংক্রামক ভাইরাস। 

অবশ্য হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অনুষদের করা আরেকটি গবেষণা বলছে, অমিক্রন করোনার অন্য ধরনগুলোর চেয়ে আলাদা। 

প্রাণীর শরীরে ও পরীক্ষাগারে করা গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, অমিক্রন ডেলটা ধরনের মতো ফুসফুসকে সংক্রমিত ততটা না-ও করতে পারে। তবে এটি শ্বাসযন্ত্রের ওপরের অংশে (আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট) খুব দ্রুত ছড়ায়। 

অমিক্রন ধরনটির আরও কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। আরেকটি গবেষণা বলছে, অমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হলে শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা ডেলটা ধরন থেকে সুরক্ষা দেয়। তবে ডেলটার সংক্রমণের পর শরীরের যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা অমিক্রন ধরন থেকে কম সুরক্ষা দেয়। তার মানে দাঁড়ায়, অমিক্রন ধরনটি ডেলটার পাশাপাশি অবস্থান না করে ডেলটা ধরনকে প্রতিস্থাপন করবে। 

অমিক্রন ধরনের তীব্রতা 

গবেষকেরা বলছেন, ডেলটার চেয়ে অমিক্রন কম গুরুতর রোগের কারণ হবে বলে তাঁদের মনে হয়। সম্প্রতি আরেক গবেষণায় এসেছে, ডেলটা ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বা ভেন্টিলেশনের মতো যে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রয়োজন হয়, তা অমিক্রন ধরনে সংক্রমিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কম লাগছে। এ ধরনে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অসুস্থতা কম হবে। এর ব্যাখ্যা হিসেবে গবেষকেরা বলছেন, আগের ধরনগুলোর তুলনায় অমিক্রন ধরনে ফুসফুসের ক্ষতির আশঙ্কা কম। কারণ, অমিক্রন শ্বাসযন্ত্রের ওপরের অংশে ছড়ায়, যা কম গুরুতর হয়ে বেশির ভাগ মানুষকে সংক্রমিত করে। 

অমিক্রনের চরিত্র ইঙ্গিত দেয়, এ ধরন ডেলটা ধরনের চেয়ে বেশি মানুষকে সংক্রমিত করবে। সিডিসির এক গবেষণা বলছে, কোনো ব্যক্তির শরীরের অ্যান্টিবডিকে পাশ কাটিয়ে সংক্রমণ করার ক্ষেত্রে অমিক্রন ধরনটি দক্ষ। ফলে এ ধরন আরও মহামারি আকারে সংক্রমণ করবে। কিন্তু টিকা নেওয়া থাকলে এ ধরনে আক্রান্ত হলেও গুরুতর রোগ হবে না। যাঁদের করোনার বুস্টার ডোজ দেওয়া, তাঁদের ৯০ শতাংশের কার্যকরভাবে হাসপাতালে ভর্তি ঠেকানো যাবে। 

অমিক্রনের এমন মৃদু চরিত্রের পরও চিকিৎসকেরা এখনো এ ধরন নিয়ে উদ্বেগে আছেন। যাঁরা টিকা নেননি বা যাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাঁরা অমিক্রন ধরনে দ্রুত আক্রান্ত ও অসুস্থ হবেন। 

পরীক্ষা পদ্ধতি 

করোনা মহামারির শুরুর দিকে বিশেষজ্ঞরা সংক্রমিত হওয়ার পাঁচ থেকে সাত দিন পর র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতেন। তবে এখন অমিক্রনের ক্ষেত্রে তাঁরা দুই থেকে চার দিনের মধ্যে এ পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন। 

গবেষকেরা বলছেন, র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ক্ষেত্রে অন্যান্য ধরনের চেয়ে অমিক্রন কম সংবেদনশীল। তাই তাঁরা অমিক্রন ধরন শনাক্তে পিসিআর পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন, যাতে ধরনটি দ্রুত শনাক্ত করা যায়। 

আইসোলেশনের নতুন নিয়ম 

সিডিসি সম্প্রতি করোনায় সংক্রমিত হলে আইসোলেশনে থাকার নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে। করোনায় সংক্রমিত হলে আগে ১০ দিন আইসোলেশনে থাকার কথা বলা হতো। এখন সিডিসি বলছে, সংক্রমিত ব্যক্তির উপসর্গ না থাকলে পাঁচ দিন পরই সে আইসোলেশন থেকে বের হতে পারবেন। তবে এই আইসোলেশনের পর তাঁকে একটি র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করতে হবে। পরবর্তী পাঁচ দিন তাঁকে মাস্ক পরে থাকতে হবে। 

সংক্রমিতদের জটিলতা তুলনামূলক কম 

এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার বাড়লেও উপসর্গের তীব্রতা কম পাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। রোগীদের অক্সিজেনের মাত্রা খুব একটা কমছে না। ফুসফুসের সংক্রমণ কম হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে না। এমনকি এখন পর্যন্ত আইসিইউর অধিকাংশ আসন ফাঁকা। রোগের লক্ষণে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সংক্রমিত ব্যক্তিদের জটিলতা তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

তিনটি হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁদেরই ভর্তি করা হয়েছে, যাঁদের শরীরে দুই বা ততোধিক রোগ আছে। এই রোগীদের করোনার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা, স্ট্রোক, কিডনি ও হৃদ্‌রোগের জটিলতা আছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের করোনা ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক মো. হাফিজ সরদার বলেন, গলাব্যথা, সর্দি, জ্বর, গায়ে ব্যথা, নাকে গন্ধ কম পাওয়া—সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো পাওয়া যাচ্ছে। তবে বেশির ভাগের তীব্রতা কম। যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগের টিকা দেওয়া ছিল না।

ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে শয্যা আছে ১ হাজার। গত শনিবার সেখানে রোগী ভর্তি ছিলেন ৯১ জন। ৪০০ আইসিইউ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগী ২৬ জন। অথচ গত বছর একসঙ্গে ২১২ জন পর্যন্ত আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। এ হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ৩৯ জন চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। তাঁদের ১৪ জনকে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, গত বছর শ্বাসকষ্টের রোগী বেশি ছিলেন। এবার তা কম। জটিলতা কম থাকায় বেশির ভাগ রোগীই বাসায় থাকতে চাচ্ছেন। জটিলতা কম থাকায় অল্প মাত্রায় ভাইরাসবিরোধী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের এখন অক্সিজেন কম লাগছে। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি ৩০ শতাংশের মতো রোগীর ২ থেকে ৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন লাগছে।

দেশে এখন করোনার রোগীদের লক্ষণগুলোর তীব্রতা কেন কম দেখা যাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক মুখপাত্র মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, একটি কারণ টিকা গ্রহণ। অনেকেই অন্তত এক ডোজ হলেও টিকা নিয়েছেন। আবার অমিক্রনে ফুসফুস সংক্রমিত হয় কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যা বলছে 

দেশে এখনো করোনার ডেলটা ধরনের প্রাধান্য আছে। তবে একটু একটু করে ডেলটার জায়গা দখল করে নিচ্ছে অমিক্রন। এ সময় অনেকেরই সর্দি বা জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিচ্ছে। ভালো না লাগলে বা অস্বস্তি বোধ করলে কী করতে হবে, তা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চার দফা পরামর্শ দিয়েছে। 

জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট থাকলে সময় নষ্ট না করে এক্ষুনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টেলিফোনে এ পরামর্শ নেওয়া যায়। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যে পরামর্শ দেয়, সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কল সেন্টার এ সেবা দিচ্ছে। ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করলে করোনা বিষয়ে সেবা পাওয়া যাচ্ছে। 

দিন কয়েক আগে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) মো. নাজমুল ইসলাম বলেছেন, ‘অতি সম্প্রতি আমাদের কমিউনিটি পর্যায়ে অমিক্রনের সংক্রমণ হচ্ছে। ডেলটার সংক্রমণ এখনো সবচেয়ে বেশি। তবে অমিক্রন একটু একটু করে সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে।’ 

মো. নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, অমিক্রনের যে উপসর্গগুলো আছে, সেগুলো যদি খেয়াল করি, তাহলে দেখব, ৭৩ শতাংশ মানুষের নাক দিয়ে পানি ঝরছে। মাথাব্যথা করছে ৬৮ শতাংশ মানুষের। অবসন্নতা বা ক্লান্তি অনুভব করছেন ৬৪ শতাংশ রোগী। হাঁচি দিচ্ছেন ৬০ শতাংশ। গলাব্যথা ৬০ শতাংশের। কাশি দিচ্ছেন ৪৪ শতাংশ রোগী। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। এর সঙ্গে মৌসুমি যে ইনফ্লুয়েঞ্জা হচ্ছে, এর সঙ্গে মিল রয়েছে। কাজেই যেকোনো পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

সূত্র: প্রথম আলো

স্বাস্থ্য এর পাঠক প্রিয়