শিরোনাম
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে নতুন শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি রোগী আর এ সময়ে শনাক্তের হার আট শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (রবিবার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা) করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ২৩১ জন। আর এ সময়ে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার আট দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত সপ্তাহে (৩ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি) করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২৩৪ জন। তার আগের সপ্তাহে (২৭ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ২ জানুয়ারি ২০২২) শনাক্ত হয়েছিলেন ৩ হাজার ২১৩ জন। অর্থাৎ গত সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় ১২৫ দশমিক ১ শতাংশ রোগী বেশি শনাক্ত হয়েছেন।
এদিকে, দেশে এখন পর্যন্ত করোনার অতি সংক্রমণশীল নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে শনাক্ত হয়েছেন ৩০ জন।
প্রসঙ্গত, দেশে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময় গত বছরের জুলাই-অাগস্ট মাসে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর সেটা কমতে কমতে গত জুলাই মাসে ২ শতাংশের নিচে চলে আসে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এরমধ্যেই বিশ্বে শুরু হয় ওমিক্রনের তাণ্ডব। গত ৩ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ এবং ৫ জানুয়ারি তা ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু তার দুইদিনের মাথাতেই ( ৭ জানুয়ারি) শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়ে হয় পাঁচ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর দুইদিন পর ( ৯ জানুয়ারি) শনাক্তের হার ছিল ছয় দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর তার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেটা গিয়ে দাঁড়ালো আট দশমিক ৫৩ শতাংশে।
ওমিক্রন দক্ষিণ আফ্রিকাতে শনাক্ত হওয়ার পর—প্রথমে বলা হয়েছিল ডেল্টার মতো ওমিক্রন সিভিয়ার নয়, মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে কম, এতে মৃত্যুও কম। কিন্তু গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ওমিক্রনকে মৃদু ভাবা ঠিক হচ্ছে না। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে সারা দুনিয়াতেই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কোভিডের আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ওমিক্রনে লোকজনের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা অপেক্ষাকৃত কম। তবে বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান ড. টেড্রোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছেন, রেকর্ড সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে।
ডব্লিউএইচও প্রধান বলেন, ‘যদিও ওমিক্রনকে ডেল্টার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর বলে মনে হয়, বিশেষ করে যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে; তবে এর মানে এই নয় যে, এটিকে হালকা হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা উচিত। আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মতোই ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালে যাচ্ছে এবং এতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।’
তিনি বলেন, আসলে সংক্রমণের সুনামি এতো বিশাল ও দ্রুত যে, এটি দুনিয়াজুড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলেছে।
দেশে সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে ওমিক্রনের প্রভাব রয়েছে ভাবলেও সরকারের রোগ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর) বলছে, এখনও দেশে ওমিক্রন নয় বরং ডেল্টার প্রভাব চলছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে চরম উদাসীনতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন ওমিক্রনকে মৃদু বলেছিল তখন এর প্রতিবাদ করেছিলাম জানিয়ে আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর জানিয়েছেন, যখন একে মৃদু বলা হয়েছিল তখন প্রতিবাদ করেছিলাম এবং এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীজুড়ে লাখো মানুষ প্রতিদিন করোনাতে শনাক্ত হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ ভাইরাসটি অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে। আর পরিবর্তিত যে কোনও ভাইরাস আমাদের জন্য যে কোনও সময় বিপদজনক হতে পারে।
করোনাতে আক্রান্ত হলে তাদেরকে আইসোলেশনে থাকার কথা বলা হয়। কিন্তু দেশের কতজন মানুষের বাসায় আইসোলেটেড হয়ে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, তাহলে তারা হাসপাতালে যাবে।
“আবার যারা কোমরবিডিটিতে রয়েছেন—যারা আগে থেকেই ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিসংক্রান্ত জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের জন্য এবং যারা ষাটোর্ধ্ব রয়েছেন, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য যে কোনও সাধারণ মৃদু ভাইরাসও ডেঞ্জারাস ( বিপদজনক) হয়ে দেখা দিতে পারে”।
“প্যান্ডেমিকের সময় যখন একটা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরার সক্ষমতা রাখে তখন এটাই ‘মোর দ্যান ইনাফ’ তাকে বিপদজনক হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। এবং আমরা সেটাই এখন দেখতে পাচ্ছি। সেই সঙ্গে এখন এতে মৃত্যুও হচ্ছে”। তাই ওমিক্রনকে মৃদু ভেবে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে উদাসীন হলে চলবে না, সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
ঘর থেকে বের হলেই মাস্ক পরতে হবে, একে জীবনের অঙ্গ করে নিতে হবে। বয়োজ্যেষ্ঠদের জরুরি কাজ না থাকলে ঘরের বাইরে না যাওয়ার কথাও বলেন ডা. এ এস এম আলমগীর।
এদিকে, গত কয়েক সপ্তাহে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চাপ বাড়ছে জানিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. কাজী তরিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে রোগীদের চাপ বাড়ছে। যাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে-তারাই ভর্তি হতে হাসপাতালে আসছেন।
“দেশে গত এক সপ্তাহের পরিসংখ্যানগত কার্ভ যদি করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এটা খুবই শার্প, অনেক শার্প রাইজ”।
বাংলাদেশে সংক্রামকব্যাধি আইন রয়েছে, সেটাও বাস্তবায়ন করা যায় না জানিয়ে অধ্যাপক কাজী তরিকুল ইসলাম বলেন, এমনকী শিক্ষিত বলে আমরা যারা রয়েছি, তারাও মাস্ক পরছি না, হেলথ বা সোশাল এটিকেট মানছি না আর অশিক্ষিত কিংবা খেটে খাওয়া অথবা নিম্নবিত্ত শ্রেণির কথা বাদই দেওয়া হলো।
দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবার পরেই মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীনতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, টিকা নিতে হবে কারণ হয়তো তাতে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু মাস্ক পরলে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এদিকে, ওমিক্রনকে মৃদু বলা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঠিক হয়নি মন্তব্য করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ডেল্টাতে যদি চারজন আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে ওমিক্রনের আক্রান্ত হবে ২০ জন।
মনে রাখা দরকার, ওমিক্রনে আক্রান্ত যত বেশি হবে, ততোই সিরিয়াস বা সিভিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে যারা টিকা নেয়নি, ষাটোর্ধ্ব, যারা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত-তারা যদি ওমিক্রনে আক্রান্ত হন তাহলে তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুতর হয়ে যাবে।
ওমিক্রন মৃদু নয়—এ বার্তাতে আমরা নিজেরাও রিলাক্টেন্ট হয়েছিলাম জানিয়ে ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, হাসপাতালে অনেক রোগীকেই পাওয়া যাচ্ছে যারা ভেতরে ভেতরে অনেক খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে সাধারণ রোগীদের ভর্তি নেওয়া কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, চাপ বেড়েছে করোনা রোগীদের।
অবস্থা গুরুতর না হলে মানুষ হাসপাতালে যায় না, তাহলে কোন পরিস্থিতিতে হাসপাতালে ভর্তি হবার হার বেড়েছে সেটাও বিবেচনায় নেওয়া আমাদের উচিত, বলেন ডা. নুসরাত সুলতানা।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন