শিরোনাম
করোনা মহামারি কমতে শুরু করলেও নতুন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। এর সঙ্গে আছে ডেঙ্গি এবং শীতকালীন ভাইরাসের আক্রমণ।
এগুলোর প্রতিরোধে কাজ চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে কিছু নির্দেশনা। কিন্তু জনগণসহ সংশ্লিষ্টদের অধিকাংশই এগুলো তেমন মানছেন না।
ফলে দেশব্যাপী শোরগোল শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় ওমিক্রন, ডেঙ্গি ও কোল্ড ডিজিজ এই তিন ভাইরাসে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন (বি.১ ১.৫২৯) প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারত পর্যন্ত ১২টি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ভ্যারিয়েন্টটি মোকাবিলায় বিধিনিষেধের ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা ছাড়া তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জনসাধারণও দ্রুত সংক্রমণশীল ভাইরাসটিকে আমলে নিচ্ছে না। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ওমিক্রনের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা থেকে আসা ২৪০ জন প্রবাসীর হদিস মিলছে না। তাদের শনাক্ত করে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে আনাও সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ধরনটি ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
ফলে দু-একটা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করে লাভ নেই। ধরনটি ভারতেও শনাক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত অনেক বড়।
দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও মানুষগুলোর মধ্যে নানা ধরনের সম্পর্ক আছে। এর ভিত্তিতে নিয়মিত বর্ডার ক্রস করছে। এটা ঠেকানো কঠিন।
সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারলেও ভালো হতো। কিন্তু ভৌগোলিক বাস্তবতায় এটা অসম্ভব। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে আমরা প্রতিনিয়ত সচেতন করছি। বর্তমানে চার কোটি টিকা মজুত রয়েছে।
দৈনিক গড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। টার্গেটকৃত জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ শতাংশ টিকার আওতায় এসেছে। কিন্তু বাকিরা নিবন্ধনে আগ্রহী হচ্ছে না।
স্বাস্থ্যবিধিও মানছে না। এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা হয়তো শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে না। কিন্তু সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে কিছুদিন পার করতে পারলে ধরনটির প্রকৃতি জানতে পারব, চিকিৎসা দিতে পারব, মৃত্যু হার কমানো যাবে।
সরেজমিন রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে এবং জেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন ধরন মোকাবিলায় এখনো অনেক হাসপাতাল প্রস্তুত নয়।
নমুনা শনাক্তকরণ বুথ, জীবাণু নশক টানেল, হাত ধোয়ার বেসিন প্রস্তুত ও কোভিড ইউনিট চালু হয়নি। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা নামমাত্র মাস্ক পরছেন।
একইভাবে গণপরিবহণ, বাজারঘাট, শপিংমলের মতো জনাসমাগমপূর্ণ স্থানে সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই নেই কারও মধ্যে। এর সঙ্গে অসময়ের ডেঙ্গি ও শীতকালীন রোগ নিয়ে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অক্টোবর ও নভেম্বর দুই মাসে দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৯ হাজার ৩৪ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গি নিয়ে ২৭ হাজার ৪৫১ জন ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে জুলাইয়ে ১২, আগস্টে ৩৪, সেপ্টেম্বরে ২৩, অক্টোবরে ২২ এবং নভেম্বরে ৭ জনের মৃত্যু হয়। এ বছর ডেঙ্গি ভাইরাস ৯৮ জন মারা গেছেন। অসময়ে ডেঙ্গির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনতে সিটি করপোরেশনসহ স্বাস্থ্য বিভাগকে বেগ পেতে হচ্ছে।
একইভাবে রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে এবং জেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে সেখানে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর আধিক্য দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ (ঢাকা) শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক রেসপিরেটরি মেডিসিন (পালমোনলজি) বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. নাবিলা আকন্দের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, ঋতু পরিবর্তনের কারণে শীতকালে শতকরা ৮০ ভাগ শিশু ভাইরাসজনিত রোগের শিকার হয়। এর মধ্যে ঠান্ডা বা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ যেমন-রাইনাইটিস বা সর্দি-কাশি, ব্রঙ্কিউলাইটিস বা হাঁচি-কাশি এবং ভাইরাল-নিউমোনিয়া সংক্রমণ, অ্যাজমা ও অ্যাটোপিকক্রাইনাটিস বাড়ছে।
এছাড়া হাল্কা, জ্বর ও বমিসহ রোটাভাইরাস ডায়রিয়া, চিকেনপক্স, মিজেলস, ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত হয়ে শিশু রোগীরা আসছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগী ঢাকা ও আশপাশের শহর থেকে আসছে। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকেও অসংখ্য শিশু আসছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, মিউটেশনের কারণে ওমিক্রনের আগেও করোনার বেশ কয়েকটি ভ্যারাইটি এসেছে। ওমিক্রন মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। ডেল্টার সময়ে আমরা বলেছিলাম যত ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হবে এবং চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে মৃত্যুঝুঁকি ততই কমবে। তবে ওমিক্রনের জটিলতা হলো আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গগুলো প্রকট হয় না কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
যা ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়লে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রথম করণীয় হলো আফ্রিকাসহ বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের পিসিআর টেস্ট করা। আইসোলেশন করে দ্রুত চিকিৎসা আওতায় আনা। দ্বিতীয়ত, তার সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের কনট্রাক্ট ট্রেসিং করা। ডেঙ্গি ও অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগব্যাধির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা চিহ্নিত করে গুরুত্ব দেওয়া।
প্রসঙ্গত গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার ২১ হাজার ২৪৪টি নমুনা সংগ্রহ করে ২১ হাজার ৫৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ সময়ে আরও ২৬১ জনের মধ্যে করোনা সংক্রামিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৩৫৪ জনকে কোয়ারেন্টিন এবং ৬২ জনকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টায় স্থল, সমুদ্র, রেলের ৯ হাজার ৫০৮ জনের স্ক্রিনিং করা হয়েছে।
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। এ বছর ৩১ আগস্ট তা ১৫ লাখ পেরিয়ে যায়। এর আগে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে ২৮ জুলাই দেশে রেকর্ড ১৬ হাজার ২৩০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়।
প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ বছর ১৪ সেপ্টেম্বর তা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তার আগে ৫ আগস্ট ও ১০ আগস্ট ২৬৪ জন করে মৃত্যু খবর আসে, যা মহামারির মধ্যে এক দিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
সূত্র: যুগান্তর