শিরোনাম
সপ্তাহে তিন দিন ভাঙা মুরগির ডিম কিনতেন সুরুজ মিয়া। পেশায় রিকশাচালক সুরুজ পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর একটি বস্তিতে। শারীরিক প্রতিবন্ধী এক কন্যাশিশুর সঙ্গে তার ছয় বছরের এক ছেলেও রয়েছে। ইদানীং তিনি ভাঙা ডিমও কিনতে পারেন না। চার-পাঁচ টাকার ভাঙা ডিম এখন সাত থেকে আট টাকায় বিক্রি হয়।
রংপুর থেকে আসা সুরুজ জানান, ‘হামরা গরিব মানুষ বাহে, এলা ডিম কিনে খাবার মুরদ নাই। ডিমের দাম দেখি-হামার ছোলপোলগুলোও এখন ডিম খাবার চায় না।’
বিক্রেতারা জানান, ডিম এখন দামি, তাজা ডিমের সঙ্গে ভাঙা ডিমের দামও বেড়েছে। সুরুজের সঙ্গে তার স্ত্রী ও সন্তানরাও ডিমের কী উত্তাপ তা টের পাচ্ছে। পুষ্টিবিদরা জানান, পুষ্টির গুরুত্বের দিক থেকে ডিম অন্যতম। ডিমের দাম বাড়লে তো অপুষ্টি মানুষের সংখ্যাও বাড়ে। পুষ্টির ঘাটতির সঙ্গে অসুখ-বিসুখও বেড়ে। অপুষ্টি এখন অধিকাংশ মানুষের নিত্যসঙ্গী।
রাজধানী থেকে বিভাগীয় শহর, মহল্লা থেকে গ্রাম-সর্বত্রই ডিমের বাজার চড়া। যে মুরগির (পোলট্রি) ডিম (একটি) কয়েকদিন আগেও সাড়ে ছয় টাকা থেকে সাত টাকা দরে পাওয়া যেত। সেখানে এখন কোথাও সেটির দাম ১০ টাকা, কোথাও ১১ টাকা। এমন ঊর্ধ্বমুখী দাম কোন পর্যন্ত যাবে তা ভেবে বেশ চিন্তিত মধ্য-নিুবিত্তের মানুষরা।
ভোক্তাদের বক্তব্য, উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও সবজি-নিত্যপণ্যে এখন হাত ছোঁয়ানো যায় না। গরু-খাসি কিংবা মহিষের মাংস তো বহু দিন ধরেই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাস তিনেক আগেও রাজধানীর কাওরান বাজারের ডিমপট্টির পাইকারিবাজারে এক ডজন (১২টি) ডিমের দাম ছিল ৭৬ টাকা থেকে ৭৮ টাকা। তবে মাসখানেক আগে আচমকা দাম বেড়েছে বলে জানান ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ী বিমল সাহা। সেগুনবাগিচা এলাকার দোকানদার মিলন শাহ জানান, দেড় মাস আগে এক ডজন ডিম খুচরা বিক্রি করেছেন ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়।
গুলিস্তান ফুটপাতের এক ডিমবিক্রেতা (ডিমের রোল) জানান, ‘ম্যালা দিন আগে ডিমের রোল (এগরোল) বেচসি ১২ ট্যাহা থেইকা কুড়ি ট্যাহা। এহন বেচসি ২৫ ট্যাহা থেকে ৩০ ট্যাহা। ডিম বেশি দাম দিয়া কিনি- হেইলাইগ্যা রোল-অ বেশি দামে বেচি।’
রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় একটি ব্যাংকে আয়া’র কাজ করেন রহিমা খাতুন। মাস শেষে এক হাজার ৫০০ টাকা পান। কমলাপুরের রেললাইন ঘেঁষা ১০ ফুট বাই ৮ ফুটের একটি ঝুপড়িতে ৫০০ টাকায় দুজন মিলে থাকেন। মতিঝিল কলোনিবাজার থেকে তিনি নামেমাত্র বাজার করেন। ভাজা ডিমের ঝোল তার বেশ প্রিয়। কিন্তু এখন তার ডিম কেনার সাহসই হয় না। আর তার ডিম খাওয়া তো দূরের কথা। এমন চিত্র শুধু রাজধানীতে নয়। দেশের অনেক জায়গায়ও ডিমের খুচরা বাজার দর অনেক চড়া।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন, ডিম ব্যবসায়ী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারিকালেও ডিমের বাজার এমন চড়া হয়ে ওঠেনি। উৎপাদন প্রায় শতভাগ হলেও ডিমের দাম বাড়ছে।
খামারি-পাইকারি বিক্রেতারা জানান, পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এ কারণে বাধ্য হয়েই ডিমের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আবার খুচরা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ইচ্ছামতো ডিমের দাম বাড়াচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন চার কোটির বেশি ডিম উৎপাদন হয়। এক লাখ পোলট্রি খামারের সঙ্গে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা সাজ্জাদ হোসেন শাহীন বলেন, পাইকারি বাজারে ১০ নভেম্বর লাল ডিম প্রতিপিসের দাম ছিল ৮ টাকা ১০ পয়সা, সাদা ডিমের দাম ৭ টাকা ৫০ পয়সা। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে ডিমের দাম একই দিন কম-বেশি হয়। খুচরা বিক্রেতা ডিমের দাম বেশি রাখলে আমাদের কিছুই করার থাকে না। বর্তমানে উৎপাদন প্রায় শতভাগ। তবে পোলট্রি ফিডের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। এতে ডিমের দাম বাড়ে।
ডিম ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার গাজীপুর খামার থেকে পাইকারি প্রতিপিস ডিম ৮ টাকা ১০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ৯৭ টাকা ২ পয়সায় এক ডজন বিক্রি হয়েছে। আর রাজধানীতে প্রতিপিস খুচরা ডিম ১০ থেকে ১১ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এক ডজন ডিম ১২০ টাকা থেকে ১২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাস দেড়েক আগেও খুচরা ডিমের ডজন ছিল ৮০ টাকা থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে।
রাজধানীর মতিঝিলের একটি বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নার্গিস আক্তার শিউলি জানান, শুধু রাজধানী নয়, সর্বত্র সন্তানদের ডিম খাওয়াতে অভিভাবকরা পছন্দ করেন। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর টিফিনে ডিম থাকে। কিন্তু ৪০ টাকা থেকে ৪৪ টাকায় এক হালি ডিম কিনতে তাদের অভিভাবকদের চিন্তা বেড়েছে।
মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমেনা খাতুন জানায়, তাদের ফেলে বাবা অন্যত্র চলে গেছে। একটি বস্তিতে মায়ের সঙ্গে সে থাকে। স্কুলে তার টিফিন আনা হয় না। আগে বাসায় মাঝেমধ্যে ভাজা ডিম দিয়ে ভাত খেতে পেত। এখন তার মা ডিম কেনে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, ডিমের প্রোটিন অত্যন্ত উচ্চমানের। ডিম মস্তিষ্ক আর পেশি গঠনে এবং রোজকার ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ডিম হলো সবচেয়ে বেশি পুষ্টিতে ঠাসা খাবার। লাল ডিম ও সাদা ডিমে প্রোটিন ও পুষ্টিগুণের কোনো ফারাক নেই। তাই একে ‘সুপার ফুড’-এর শিরোপা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। শিশু থেকে বয়স্ক সবার পুষ্টি নিশ্চিত করতে ডিম ও ডিম উৎপাদনে ভর্তুকি এবং প্রণোদনা দেওয়া উচিত। ডিম সব সময় নিুবিত্তদের নাগালের মধ্যে থাকা উচিত। কারণ ডিমের দাম বাড়লে মধ্যবিত্তের ঘরে পুষ্টিতে আঘাত আসে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, বিশ্বের এমন কোনো হাসপাতাল নেই যেখানে রোগীর খাদ্যে ডিম দেওয়া হয় না। সবখানে ডিম থাকবেই।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রফেসর ড. শওকত আরা শাকুর মিলি বলেন, অসুস্থ ব্যক্তিদের অন্যতম পুষ্টিকর খাবার হলো ডিম। চোখ ভালো রাখতেও ডিমের কোনো জুড়ি নেই। একমাত্র ডিমে আছে সঠিক পরিমাণে ক্লোরিনা। তাই বুদ্ধি বাড়াতে আর স্মৃতিশক্তি বজায় রাখতে ডিম উপযুক্ত খাদ্য। ডিমে থাকা লিউটেইন ও জিআক্সানথিন চোখ ভালো রাখে। এ কারণে ডিমের দাম সব মানুষের নাগালের মধ্যে থাকা জরুরি। তিনি আরও বলেন, কী পরিমাণ ডিম উৎপাদন হলো সেই হিসাব মুখ্য নয়। ডিমের দাম কমিয়ে সবার ক্রয়সীমার মধ্যে রাখাই মুখ্য হওয়া উচিত।
পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো জানান, ডিম নিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। ডিমের রঙ বদলায় কেবল মুরগির খাদ্যের ওপর নির্ভর করে। লাল ও সাদা দুই ধরনের ডিমের পুষ্টিগুণ প্রায় একই। ৫০ গ্রাম ওজনের ডিমে ৭২ ক্যালোরি ও ৪.৭৫ গ্রাম ফ্যাট (দ্রবণীয় মাত্র ১.৫ গ্রাম) থাকে। তিনি বলেন, কাঁচা ও অতিরিক্ত তেলে না ভেজে সিদ্ধ ডিম প্রতিদিনের মেনুতে রাখা উচিত।
সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে ডিমের দাম রাখা উচিত মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, খুচরা বাজারে ডিমের হালি ৩০ টাকার মধ্যে থাকা উচিত। সাধারণ মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে ডিম উৎপাদনে ভর্তুকি দেওয়া হোক।
পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা জানান, ডিমে অনেকটা কোলেস্টেরল আছে। কিন্তু তা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। বরং হার্টের উপকারী হাই ডেনসিটি কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) পরিমাণ বাড়িয়ে হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে। হার্টের অসুখ বা কোলেস্টেরলের ভয়ে যারা ডিম খেতে ইতস্তত করেন তাদের আশ্বস্ত করেছেন পুষ্টিবিদরা। সূত্রঃ যুগান্তর