শিরোনাম
রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি দেশের প্রায় ৬১টি জেলায়ও দ্রুত ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। শুধুমাত্র গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা ও সুনামগঞ্জ এখনও ডেঙ্গুমুক্ত। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৪ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে ৪২৭ জন। এ সময়ে মারা গেছেন সাতজন। শনাক্ত ও মৃত্যু দুটোই এ বছরের সর্বোচ্চ।
এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুকে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা বিবেচনা করে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি দেশজুড়ে মশা নিধনের উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর পাশাপাশি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন। তবে অনেক এলাকায় রোগী ব্যবস্থাপনার কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় রোগীরা বিপাকে পড়ছেন। মশা নিধন কার্যক্রম ঢিলেঢালা হওয়ায় ক্রমেই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে ঢাকার বাইরে মোট রোগী শনাক্ত হয় ১ হাজার ৮৯৯ জন। আর জুলাইয়ের প্রথম ১১ দিনে শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৪ জন। গত ছয় মাসে ঢাকার বাইরে ১০ জনের মৃত্যু হয়। আর শেষ ১১ দিনে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৯৭, এর মধ্যে ৪ হাজার ৬০৫ জন ঢাকার বাইরের। আর ঢাকা বিভাগে এ পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ২৯২ জন। মারা গেছেন ৮৩ জন। চট্টগ্রাম বিভাগের ১ হাজার ৭৭০ জন আক্রান্তের বিপরীতে মারা গেছেন ১২ জন। বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ১৩৮ রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে একজনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে মোট রোগীর ৯৯ শতাংশই ছিল ঢাকার। ২০১৭ সালে ৯৬ শতাংশ রোগী ছিল ঢাকায়, ঢাকার বাইরে ছিল ৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে শতভাগ রোগীই ছিল ঢাকার। ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়, সে বছর ৫১ শতাংশ রোগী ছিল ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে ছিল ৪৯ শতাংশ। এরপর থেকেই ঢাকার বাইরের রোগী বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে ঢাকার ডেঙ্গু রোগী ছিল ৮৭ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে ১৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ঢাকায় ৮৩ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে ছিল ১৭ শতাংশ। গত বছর ঢাকার বাইরে ৩৭ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়। এ বছর এরই মধ্যে ঢাকায় ৬৯ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে ৩১ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৩০২ রোগী সারাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে গত ১১ দিনে ৬ হাজার ৯১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছেন ৩৬ জন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সমকালকে বলেন, গ্রামেও প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার বাড়ছে। যে কারণে শহরের পাশাপাশি গ্রামেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। এখন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার তিন স্তরের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। প্রথমত, গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র করা। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত হলেও যারা গুরুতর রোগী নয়, তারা যাতে মশারি টানিয়ে বাড়িতে থেকেই সেবা নিতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা। পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক হলে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা। তৃতীয়ত, শিশু, সন্তানসম্ভবা নারী ও বৃদ্ধ বা যাদের পুরোনো রোগ আছে, তাদের অবশ্যই কাছাকাছি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও মশা নিধন অভিযান নেই। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। রোগী ব্যবস্থাপনাতেও রয়েছে ঘাটতি। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে এখন দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ঢাকাতে এরই মধ্যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাজধানীর বাইরেও পরিস্থিতি ওই দিকে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কিছু দিন পর আক্রান্তের একটি বড় অংশ জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবে এবং মৃত্যুও বাড়বে। এখন এটাকে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা ধরে নিয়ে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত ২০ থেকে ২৫ বছরে বাংলাদেশে কত মানুষের ডেঙ্গু হয়েছে, তার সঠিক তথ্য নেই। কারণ অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু রোগ নির্ণয় করা হয়নি। অনেকে চিকিৎসকের কাছেই যাননি। ফলে প্রকৃত সংখ্যাটা অনেক বেশি। এ কারণে এবার যত বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে, তাদের অনেকেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। সেবা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন– সবাইকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।