শিরোনাম
দেশে মানসিক রোগীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা এখনো চরমভাবে অবহেলিত রয়ে গেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৯ শতাংশ বিষণ্নতা, অবসাদ ও উদ্বেগসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ভুগলেও তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা খুবই অপ্রতুল। মানসিক রোগে আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য হাসপাতালে শয্যা, ওষুধপত্র, প্রশিক্ষিত মনোরোগ চিকিৎসক, নার্স, কাউন্সিলারসহ অন্যান্য জনবলের মারাত্মক সংকট রয়েছে।
মানসিক রোগের চিকিৎসা এখনো রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহরেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংকট, মানসিক রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থ বরাদ্দ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং কুসংস্কারের কারণে মানসিক রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশে প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে সাত হাজার শিক্ষার্থী এমবিবিএস পাশ করেন। তাদের মধ্যে খুব সীমিত সংখ্যক মানসিক রোগীর বিশেষায়িত চিকিৎসার্থে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩০ লাখের বেশি হলেও তাদের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২৬০ জন। শুধু তাই নয়, দেশের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ মানসিক রোগীর চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ বিনামূল্যে মানসিক রোগের ওষুধপত্র পান।
গত ২১ আগস্ট বৃটিশ জার্নাল অব সাইকেয়েট্রিতে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি পেপার অন মেন্টাল হেলথ-বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিনিধিত্বমূলক এক জরিপ অনুসারে দেশের মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে (১৬ কোটি ৩০ লাখ) প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের ব্যাপকতা রয়েছে। পুরুষদের মধ্যে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছেন। একইভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক ঐ জরিপে মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে শিশুদের মধ্যে মানসিক রোগের ব্যাপকতা ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে ছেলেশিশুদের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও মেয়েশিশুদের ১১ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারি করোনার কারণে মানসিক রোগের ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের (৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ বিষণ্নতা, ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ অবসাদ এবং ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশের উদ্বেগ) লক্ষণ রয়েছে। যা করোনাপূর্ব জরিপের তুলনায় অনেক বেশি। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে ঘরবন্দী স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা, অবসান ও উদ্বেগের হার যথাক্রমে ২৮ দমমিক ৫ শতাংশ, ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৪৬ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এমন এক পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে রোববার (১০ অক্টোবর) বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংরাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট মেন্টাল হেলথ (বিএসিএএমএইচ) সভাপতি ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে মানসিক ব্যাধির ব্যাপকতা অনেক বেশি। চিকিৎসাসেবা অবহেলিত, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা পায় না। মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে সরকারি সুপরিকল্পিত নীতিমালা, প্রশিক্ষিত মনোরোগ চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মী, অপর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ ও কুসংস্কারজনিত কারণে মানসিক রোগের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাকালে মানসিক রোগের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুনতাসির মারুফ বলেন, করোনা মহামারিকালে বিভিন্ন কারণে ব্যক্তি ও পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বহু পরিবারে নিকটজনের মৃত্যু, করোনাপরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিলতা ও সুস্থ বিনোদেনের সুযোগ সংকোচনের ফলে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, অপ্রতুল-অপ্রস্তুত স্বাস্থ্যসেবার নানা অভিজ্ঞতা, হাসপাতাল ও আইসিইউতে মৃত্যুবেদনা ও কান্নার প্রত্যক্ষ দর্শন-এসব কিছুই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধে নেওয়া বিভিন্ন ব্যবস্থা-আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলাসহ নানা স্বাস্থ্যবিধি, রোগে পরোক্ষ প্রভাবে বেড়ে যাওয়া বেকারত্ব, ভেঙেপড়া অর্থনীতি, স্থবির শিক্ষাব্যবস্থা, সুস্থ বিনোদনের সুযোগ সংকোচনের ফলে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সূত্র: জাগো নিউজ