শিরোনাম
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসক অধ্যাপক বি. কে. দাসের (বিজয়) বিরুদ্ধে ‘শিশুহত্যা’র অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি হাসপাতাল এবং ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আরও অর্ধডজন অভিযোগ তুলেছেন এক দম্পতি। উত্থাপিত অভিযোগের তদন্তও করছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সূত্র: জাগো নিউজ
জানা গেছে, গত ২১ আগস্ট আব্দুল্লাহ আল আযান নামের ১১ মাস বয়সী এক শিশুকে আংশিক তালুকাটা চিকিৎসার জন্য কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. বি. কে. দাসের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করা হয়। ২২ আগস্ট অস্ত্রোপচারের পর ওই শিশুটি মারা যায়। এ নিয়ে আযানের বাবা আব্দুল্লাহ আল সায়েম ও মা তানজুম আক্তার বিএমডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঢাকার সিভিল সার্জন বরাবর ‘শিশুহত্যার’ অভিযোগ তুলে ঘটনার বিচার দাবি করেন।
হাসপাতাল ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অদক্ষ জনবল দিয়ে প্যাথলজি ল্যাব পরিচালনা, চিকিৎসকের গাফিলতি, ডিউটি ডাক্তারের অনুপস্থিতি, নার্সের ভুল নির্দেশনা, ডেথ সার্টিফিকেটে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগ করেন ওই দম্পতি।
এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিএমডিসি থেকে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ করে জবাব দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছেন ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। বিষয়টি ডিজি অফিসকে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) জানিয়েছি।’ তদন্ত কমিটি তাদের কাজ করছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে বিএমডিসির চাওয়া জবাব দিয়েছেন অভিযুক্ত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. বি. কে. দাস। তিনি নিজেই এ তথ্য জানিয়েছেন।
অভিযোগে যা আছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, বিএমডিসি ও সিভিল সার্জনের কাছে অভিযোগে আব্দুল্লাহ আল সায়েম ও তানজুম আক্তার দম্পতি উল্লেখ করেন, ‘আমার সন্তান হত্যার জন্য আমি অধ্যাপক ডা. বি. কে. দাস (বিজয়) ও কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত অভিযোগগুলো উত্থাপন করছি ও আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাচ্ছি।’
ঘটনার বিবরণ দিয়ে ওই দম্পতি বলেন, ‘আমাদের ছেলে আযানকে গত ২১ আগস্ট আংশিক তালুকাটা চিকিৎসার জন্য মোহাম্মদপুরে কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. বি. কে. দাসের (বিজয়) কাছে নিয়ে যাই। ছেলের নিউরোলোজির সমস্যা থাকায় তার আগের সব প্রেসক্রিপশন ও টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে তার কাছে যাই আমরা। ডা. বি. কে. দাস এর সঙ্গে তালুকাটা চিকিৎসার কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান এবং পরদিন সার্জারির জন্য ব্লাড টেস্ট ও হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন।’
হাসপাতালে অদক্ষ জনবল দিয়ে ব্লাড কালেকশন ল্যাব পরিচালনা করা হচ্ছিল অভিযোগ করে ওই দম্পতি বলেন, ‘তারা আমার বাচ্চার রগ খুঁজে পাচ্ছিল না। এক ঘণ্টা ধরে রগ খুঁজে না পেয়ে তারা আমার ছেলের দুই হাতে একই জায়গায় বারবার ফুটো করে। এর ফলে বাচ্চার দুই হাতে লাল লাল ছোপ পড়ে যায়। এরপর বাচ্চা সারারাত হাতের ব্যথায় কান্না করে।’
সার্জারির আগে বাচ্চাকে খাওয়াতে নিষেধ করা, দীর্ঘ সাড়ে সাত ঘণ্টা না খাওয়ানোর পর বাচ্চাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার অভিযোগ করে তারা বলেন, ‘আড়াইটায় আমার বাচ্চাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর বাচ্চাকে বের করে পাশের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে দেন তারা। এসময় বাচ্চার নাক-মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত বের হচ্ছিল।’
অপারেশনের পরে বাচ্চার অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ওই দম্পতি বলেন, ‘বাচ্চাকে যখন পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে দেওয়া হয় তখন তার বুকে শব্দ হচ্ছিল, নিশ্বাস নিতে পারছিল না। সেসময় তার শরীর প্রচণ্ড গরম ছিল, পুরো মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল। রক্তপাত ও বুকের শব্দ থামছিল না। সেসময় সেখানে কোনো দায়িত্বরত চিকিৎসক ছিলেন না।’
দায়িত্বরত চিকিৎসক না থাকা ও নার্সের খারাপ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, ‘চিকিৎসক না থাকায় নাক-মুখ দিয়ে বের হওয়া রক্ত মোছার জন্য নার্স আমাদের হাতে কিছু গজ ধরিয়ে দেন এবং তিনটি ওষুধ দিয়ে নিচে বেডে চলে যেতে বলেন। এছাড়া তিন ঘণ্টা পর বাচ্চাকে ওষুধ খাওয়াতে বলেন। কিন্তু তখন বাচ্চার জ্ঞান না ফেরা ও নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়ায় আমরা ওষুধ দিচ্ছিলাম না। পরে নার্সের ধমকে আমরা বাচ্চাকে ওষুধ দেই কিন্তু বাচ্চা মুখ থেকে ওষুধ ফেলে দেয়।’
সেই সময়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে ওই দম্পতি অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, ‘বাচ্চার শ্বাসকষ্টের আরও অবনতি হওয়ায় এবং অপারেশনের এত পরেও ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক উপস্থিত না হওয়ায় আমরা বাচ্চা নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে যাই। সেখানে ডা. বি. কে. দাসকে বলি—‘স্যার আমার বাচ্চার অনেক কষ্ট হচ্ছে।’ তিনি ‘সব ঠিক আছে’ বলে এক প্রকার ধমক দিয়ে আমাদের বের করে দেন। পরে আমরা আবার নিচতলায় বেডে চলে আসি।’
‘কিন্তু বাচ্চার শ্বাসকষ্ট কমছে না বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ পর ওপরে অপারেশন থিয়েটারের পাশে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে অনেকটা জোর করে বাচ্চাকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমার বাচ্চা স্থির না হওয়ায় পাঁচ মিনিটের বেশি অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর বাচ্চা নিয়ে নিচে চলে যাওয়ার দশ মিনিট পর বাচ্চা ছটফট করতে করতে চুপ হয়ে যায়। আমি বাচ্চাকে বুকে নিয়ে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি, বাচ্চা আর শ্বাস নিচ্ছে না, নিথর হয়ে গেছে তার দেহ।’
সার্জারির পর চিকিৎসকের অনুপস্থিতি ও নার্সের ভুল নির্দেশনার কথা জানিয়ে তারা বলেন, ‘অপারেশনের পর সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কোনো ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক না থাকায় আমরা বাচ্চাকে নিয়ে দৌড়ে আবারও অপারেশন থিয়েটারের সামনে নিয়ে যাই। এসময় চিকিৎসক আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন—নার্স ভুল করেছেন মুখে ওষুধ দিতে বলে, এর ফলে হয়তো ফুসফুসে ওষুধ আটকে থাকতে পারে। একই সঙ্গে নিচে ওয়ার্ডে দায়িত্বপালন করা চিকিৎসকের অনুপস্থিতির কথাও তারা স্বীকার করেন।’
ডেথ সার্টিফিকেট মিথ্যা তথ্যে ভরা অভিযোগ করে ওই দম্পতি বলেন, ‘রাত সাড়ে ১০টায় বাচ্চা মারা যাওয়ার পর আমরা বাচ্চা নিয়ে সাড়ে ১২টায় চলে আসি। দাফনের জন্য ডেথ সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হলে বাচ্চার দাদি হাসপাতালে যান, সেখানে তাকে মিথ্যা তথ্যে ভরা ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ভর্তির ডেট দেওয়া হয়েছে ২২ তারিখ, যা আসলে ২১ তারিখ হবে। মৃত্যুর কারণ এসপিরেশন নিউমোনিয়া দেওয়া হয়, যা আসলে ডাক্তারের গাফিলতি, অবহেলা, নার্সের ভুল নির্দেশনা হবে।’
এসব অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরে সায়েম-তানজুম দম্পতি তাদের সন্তানের মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলে উল্লেখ করেন এবং ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তিসহ বিচার দাবি করেছেন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
এ বিষয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক অধ্যাপক বি. কে. দাস বলেন, ‘যেহেতু অভিযোগ হয়েছে, অভিযোগ তদন্ত হবে। তদন্তের পরে যা হওয়ার হবে। এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক পারভীন ফাতিমা বলেন, ‘এটা আমি জানি। বাচ্চাটাকে তিন চার ঘণ্টা পরে রিকভারি হয়ে যাওয়ার পর মায়ের কাছে (বেডে) দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাচ্চার মা বাচ্চাটাকে নিয়ে বেডে ঘুমিয়ে গেছে। ঘুম থেকে ওঠে দেখে বাচ্চাটা আঁকা-বাঁকা হয়ে আছে। কোনো একটা চ্যানেলে সে এ কথা বলেছে, আমি শুনেছি। তার মানে, কী চাপ দিয়ে যে ঘুমিয়েছিল, আল্লাহ-ই জানে। তারপর আমাদের ওপর দোষ কী করে আসে? ডাক্তারের ওপর দোষ কী করে আসে? অ্যানেস্থেটিক তিনবার দেখে দিয়েছে বাচ্চাটাকে। মা কোন আক্কেলে বাচ্চার ওপর শুয়ে পড়লো? বাচ্চার বিছানায় তো তার (মা) শোয়ার কথা না। বাচ্চা দিয়েছি আমরা, সে বসে থাকবে, বাচ্চা পাহারা দেবে। বাচ্চা ঘুম থেকে উঠলে নিয়ে বাসায় চলে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘সব দোষ যদি প্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে যায়, আমরা তো কাজ করতে পারবো না। এই কাজগুলো আমরা ফ্রি কাজ করি, আমরা পয়সা রাখি না। বি কে দাস একটা প্রোগ্রাম করেন। তিনিও সেবা দেওয়ার জন্যই করেন। এত হাজার হাজার কাজ তিনি করছেন, তার মধ্যে একটা অ্যাকসিডেন্ট...। এটা তো বি কে দাসের জন্য নয় যে, অপারেশনের সময় মারা গেছে, অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার সময় মারা গেছে, সে রকম তো নয়। বাসায় গিয়েও তো একই কাজ হতে পারতো। কী বলবো? আমার আসলে বলার কিছু নেই। আপনাদেরও বুঝতে হবে, প্রতিষ্ঠানকে এ রকম বিধ্বস্ত করা ঠিক নয়। আমরা সেবামূলক কাজ করি, বি কে দাসও সেই সেবামূলক কাজ করছেন।’
অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও অভিভাবকদের ফোনালাপের কয়েকটি রেকর্ড হাতে এসেছে, সেখানে উত্থাপিত অভিযোগ স্বীকার করে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতার ইঙ্গিত মিলেছে।