শিরোনাম
দুই হাজার শিক্ষার্থী থাকার উপযোগী হলটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরও পড়ে ছিল প্রায় তিন মাস। ১০ তলা ভবন দুটির লিফট কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে লিফট না বসিয়েই ভবন দুটি ফেলে রেখেছিল ঠিকাদার। অবশেষে লিফট ছাড়াই গত ১ অক্টোবর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) আবাসিক হল দুটির পঞ্চম তলা পর্যন্ত এক হাজার শিক্ষার্থীকে আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও নিজ নিজ আসনে উঠে গেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এমন অনেক বিষয়েরই দ্রুত সমাধান হবে বলে আশাবাদী শিক্ষার্থীরা। বেশ কয়েক দিন অচলাবস্থার পর নতুন উপাচার্যের নিয়োগ হয়েছে। আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে ক্যাম্পাস। উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মজিদ বলেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে লিফট স্থাপনের ব্যবস্থা করা হবে। তখন দুটি আবাসিক হলে আরও এক হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন-সুবিধা নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবন পুরোপুরি চালু করা হবে।’
গবেষণায় প্রাণবন্ত
২৩ অক্টোবর ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেল, পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং (পিএমই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা টানেল তৈরির প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু একাডেমিক ভবনের সামনে জড়ো হচ্ছেন। তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে তৈরি হচ্ছিলেন তাঁরা। নির্দেশনা দিচ্ছিলেন বিভাগের টেকনিক্যাল অফিসার আবু হেনা মো. নাসিমুল জাবিল।
শিক্ষার্থীরা জানালেন, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে এই বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া নষ্ট ব্যাটারি ও ব্যবহারের অনুপযোগী ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে মূল্যবান ধাতব সংগ্রহের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করাও তাঁদের গবেষণার বিষয়।
বিভিন্ন ভবনের সামনে ও ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বরে কয়েকজন অভিভাবককে ছবি তুলতে দেখা গেল। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসেছেন তাঁরা। বোঝা গেল, প্রথম দিনের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি চলছে অভিভাবকদেরও পরিচিতিপর্ব।
গবেষণায় এরই মধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে যবিপ্রবি। এ বছর টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংয়ে বৈশ্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ৮০০-১০০০-এর মধ্যে। দেশের মধ্যে যৌথভাবে চতুর্থ।
এই ক্যাম্পাসে মাছ নিয়ে হয় নানা গবেষণা
বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসআইআরএল নামে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার আছে, যার মাধ্যমে প্রতিবছর বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২০০ নমুনা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয় নির্দিষ্ট ফি। বিশেষ করে বেনাপোল স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি পণ্য ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে খাদ্য তৈরির কাঁচামালের নমুনা পরীক্ষার জন্য এখানে আনা হয়। খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থেকেও কিছু নমুনা আসে। তা ছাড়া প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২০টি বিভাগের অভ্যন্তরীণ অন্তত ৫০০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের ল্যাবে গিয়ে দেখা গেল, একঝাঁক শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন।
গলদা, বাগদা ও ভেনামি চিংড়ি মাছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কী কী উপাদান কত মাত্রায় আছে; হাপাতে চাষ করা চিংড়ি ও বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে চাষ করা চিংড়ির মধ্যে কোনটিতে আমিষ বেশি; বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীতে ডায়াবেটিস ও হাইপার টেনশন কমানোর মতো কোনো উপাদান আছে কি না ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তাঁরা।
মিউজিয়ামে আছে ৪০০ প্রজাতির মাছ
ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের মৎস্য মিউজিয়ামে গিয়ে দেখা গেল, বড় একটা ঘরে সারি সারি কাচের পাত্র। সেগুলোয় রাসায়নিকের মাধ্যমে বা শুকিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ও সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষণ করা আছে। তিনটি পাত্রে তিন ধরনের সাপও চোখে পড়ল। এ ছাড়া ছোট ছোট কাচের কাঠামোর মধ্যে রুই, কাতলা ও সিলভার কার্পের মতো বড় কয়েকটি মাছের কঙ্কাল রাখা আছে। এই মিউজিয়ামে ১৫০ প্রজাতির দেশি ও ২৫০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষণ করা রয়েছে।
মিউজিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণত বাজারে ৩০ থেকে ৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে আছে সমৃদ্ধ এক মৎস্যভান্ডার। ২০১৪-১৫ সালের দিকে এসব মাছ আমরা বোতলে করে সংরক্ষণ শুরু করি। এসব মাছ তখন ল্যাবেই রাখা হতো। পরে ২০১৯-২০ সালের দিকে সুন্দরবনের কাঁকড়া নিয়ে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করি। তখন সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন প্রজাতির তিনটি সাপ ধরে সংরক্ষণ করা হয়। এ সময় অন্যান্য সামুদ্রিক মাছও সংরক্ষণ করা হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি কক্ষ বরাদ্দ দিয়ে মৎস্য মিউজিয়াম করার অনুমতি দেয়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ৬০০ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ বিনা মূল্যে এই মিউজিয়াম পরিদর্শন করেছেন।’
ক্যাম্পাসের হ্যাচারিতে চাষিদের আস্থা
মাছের রেণুপোনা উৎপাদনের জন্য যবিপ্রবিতে বিশাল একটি হ্যাচারি আছে, গবেষণার পাশাপাশি প্রতিবছর এখানে বিভিন্ন মাছের ৫০০ থেকে ৬৫০ কেজি রেণু উৎপাদন করা হয়। মানসম্পন্ন এই রেণু ইতিমধ্যে চাষিদের আস্থা অর্জন করেছে।
হ্যাচারিতে গিয়ে দেখা গেল, হাউসে চিংড়ির রেণু রয়েছে। বায়োফ্লকে গলদা চিংড়ি চাষ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন কামরুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী। তিনিই অন্য শিক্ষার্থীদের তাঁর কাজ দেখাচ্ছিলেন।
হ্যাচারির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক আনিসুর রহমান বলেন, ‘গত বছর গবেষণার পাশাপাশি ৬৫০ কেজি রেণু উৎপাদন করেছি আমরা। অন্তত ৩০০ মৎস্যচাষি এই হ্যাচারি থেকে রেণু সংগ্রহ করেছেন। আমাদের উৎপাদিত রেণু দুই দিন বয়স থেকে বিক্রি শুরু হয়। যেখানে অন্য হ্যাচারিতে চার দিন বয়স থেকে বিক্রি শুরু হয়। প্রতিটা রেণু স্বাস্থ্যবান। আমাদের পানিতে আর্সেনিক ও আয়রনের মাত্রা কম হওয়ায় রেণুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য একবার যে চাষি এখান থেকে রেণু নিচ্ছেন, তিনি বারবার আসছেন। চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু আমাদের উৎপাদন কম বলে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।’
আনিসুর রহমানের বক্তব্য, অন্তত ১০টি পুকুর থাকলে চাহিদা মেটানো যেত। এখন ক্যাম্পাসে পুকুর আছে মাত্র দুটি। তা ছাড়া এই হ্যাচারিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তাই বাইরের লোক দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ ঠিকমতো উঠছে না।
উপাচার্য আবদুল মজিদ বলেন, ‘গবেষণাকে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আন্দোলনের কারণে যে সেশনজট হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য নিয়মিত পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলবে। সব কটি ক্লাব যেন সক্রিয় থাকে, সে উদ্যোগও নেওয়া হবে।’