শিরোনাম
দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে সম্প্রতি একাধিক বিষয় নিয়ে বড় ধরনের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। এর জেরে পুঁজি হারাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের তথ্য চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাল্টা চিঠি দিয়ে এ ধরনের তথ্য চাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। এর ফলে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার তথ্য ছড়িয়ে পড়ে শেয়ারবাজারে। যার প্রভাবে টানা দরপতন দেখা দেয় বাজারে। এতে প্রতিদিনই শেয়ারের দাম কমে বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
এর আগে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়েও দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। তবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে দেখা দেওয়া বিরোধ বিনিয়োগকারীদের আতংকিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছেন।
এ পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) বৈঠকে বসতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি। এই বৈঠক থেকে ভালো ফল না এলে পুঁজিবাজারে আরও বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য তারা এটাও বলছেন, দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার বৈঠক থেকে ভালো সিদ্ধান্ত এলে বাজার আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।
গত ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া চিঠিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ ও দায়ের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদ ও দায়ের তথ্য লাগবে জানিয়ে বলা হয়, ‘আর্থিক জরিপ কার্যক্রমে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও দায়ের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জরিপের ফরমে কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে।’
এর প্রেক্ষিতে ১৮ নভেম্বর বিএসইসি থেকে এক চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে বলা হয়, পুঁজিবাজার অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই বাজারের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে তদারকির দায়িত্ব পালন করে তারা। প্রত্যেক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও পক্ষের কাছে থাকা তথ্য মূল্য সংবেদনশীল হতে পারে, যা বিএসইসির অনুমোদন ছাড়া বা অনুমোদিত পন্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ ও প্রকাশ করা যায় না। বিদ্যমান ১৯৬৯ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ১৯ ধারায় এসব তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন রশি টানাটানির মধ্যে পড়ে টানা দরপতন দেখা দিয়েছে শেয়ারবাজারে। গত ১৮ নভেম্বরের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া সাত কার্যদিবসের প্রতি কার্যদিবস পতনের মধ্য দিয়ে পার করেছে শেয়ারবাজার। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে এর আগেও পুঁজিবাজারে দরপতন দেখা গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সমন্বয়হীনতা প্রকট রূপ নিয়েছে। যার ফলে বাজারে টানা দরপতন হচ্ছে। আর এতে পুঁজি হারাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টার ফলে দীর্ঘদিন পর শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বিনিয়োগকারীরাও লোকসান কাটিয়ে মুনাফার মুখ দেখছিলেন। কিন্তু বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যকার বিরোধ তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই সংস্থার মতবিরোধ দূর না হলে সামনে পুঁজিবাজারে আরও বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, মাসের শেষ সময় হওয়ায় কিছু বিনিয়োগকারী বিক্রির চাপ বাড়িয়েছেন। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ায় বিনিয়োগকারীরা সেখান থেকে মুনাফা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ কারণেই সম্প্রতি শেয়ারবাজারে কিছুটা দরপতন দেখা দিয়েছে। আমার ধারণা এটা সাময়িক। শিগগির বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজারে যে দরপতন হচ্ছে তার মূল কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যকার সমন্বয়হীনতা। এটা বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তবে আমরা আশা করছি, মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে যে বৈঠক হবে, সেখান থেকে ভালো ফলাফল আসবে, যা বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ কমাবে।
দুই মাস ধরে পতনে শেয়ারবাজার
সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন দেখা দিলেও এই পতনের ধারা দেখা দেয় অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে। এই পতন শুরু হওয়ার আগে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়ে এক ধরনের মতবিরোধ দেখা দেয়। শেয়ারবাজারে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে। গত ৩ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৭ হাজার ৩৫৬ পয়েন্টে। সেখান থেকে কমতে কমতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক এখন (২৮ নভেম্বর) ছয় হাজার ৭৭৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ডিএসই প্রধান সূচক হারিয়েছে ৫৮৩ পয়েন্ট।
বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছেন হাজার কোটি টাকা
গত ৩ অক্টোবর ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল পাঁচ লাখ ৮২ হাজার ৯০১ কোটি টাকা, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে বাজার মূলধন কমেছে ৪১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ কমেছে।
তলানিতে লেনদেন
লেনদেন খরা কাটিয়ে চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে লেনদেনের গতি নতুন মাত্রা পায়। ডিএসইতে প্রতি কার্যদিবসে দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হওয়া অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে দেখা দেওয়া বিরোধের কারণে লেনদেনের গতিতেও ছেদ পড়ে। ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে লেনদেন হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, সাত মাসের মধ্যে ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সূত্র: জাগো নিউজ