কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

ফানাম নিউজ
  ১৯ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৩১

গত ১ সেপ্টেম্বর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এরপর থেকে গত আড়াই মাস ধরে রিজার্ভ আর বাড়ছে না। উল্টো কমছে। বর্তমানে সেই রিজার্ভ এসে দাঁড়িয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ গত আড়াই মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। 

গতকাল বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলার।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রফতানি আয় বাড়লেও অস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, অন্যদিকে অস্বাভাবিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। যে কারণে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ পড়েছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ইতিহাসে গত ২৪ আগস্ট প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নতুন রেকর্ড ছুঁয়ে যায়। ৮ সেপ্টেম্বরে এই রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর এই রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের নেমে আসে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, রফতানি আয় বাড়লেও অস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা ধাক্কা লেগেছে। যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের মতো বাড়ছে না। তবে রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ এখনও আছে। বর্তমানে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ রয়েছে। এটা দেশের অর্থনীতি যে শক্তিশালী তার ইঙ্গিত করে।

অবশ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এর আগে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে,  চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি ব্যয়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় এই বছরের সেপ্টেম্বরে আমদানি বেড়েছে ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে আমদানি ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৪৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে হঠাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহে ছন্দপতন ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতা আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেও দেখা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে যে পরিমাণ রেমিট‌্যান্স দেশে এসেছে, তা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২০ সালের অক্টোবরে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৮ দশমিক ০৫ শতাংশ। এই বছরের অক্টোবরে উল্টো নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী—২০২০ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর এই চার মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪৩ শতাংশের বেশি। অথচ এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই থেকে অক্টোবর) কোনও প্রবৃদ্ধি হয়নি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত চার মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর—এই চার মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৭০৫ কোটি ৫১ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ৮৮১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ, গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে ১৭৬ কোটি ডলার।

যদিও গত বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় এই বছরের অক্টোবরে রফতানি আয়ও বেড়েছে ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর এই চার মাসে রফতানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ অক্টোবর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।

মূলত রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই রিজার্ভ এই অবস্থানে পৌঁছেছে। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ সহায়তা ও রফতানি আয়ের ইতিবাচক ধারা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। এর মাত্র ২০ দিন আগে অর্থাৎ গত ৭ অক্টোবর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুতে মার্চ শেষে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে ৭ মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরে মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে রিজার্ভে ৮ বার রেকর্ড হয়েছে।

২০২০ সালের ৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই গত বছরের ৩০ জুন রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এর এক মাস পর ২৮ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। এর তিন সপ্তাহ পর ১৭ আগস্ট রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এরপর ২ সপ্তাহের ব্যবধানে ১ সেপ্টেম্বর তা ৩৯ বিলিয়নের ঘর অতিক্রম করে। এর ৫ সপ্তাহ পর গত ৭ অক্টোবর তা ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং এর তিন সপ্তাহ পর ২৮ অক্টোবর ৪১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন