আপিল নিষ্পত্তির আগেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর!

ফানাম নিউজ
  ০৪ নভেম্বর ২০২১, ১১:১২

চার বছর আগে যশোরে দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়েছে আদালতপাড়াসহ দেশের সর্বত্র। আপিল নিষ্পত্তির আগেই তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে-আসামির পরিবারের বরাত দিয়ে এমন দাবি আইনজীবীর। অন্যদিকে কারা কর্তৃপক্ষের দাবি-সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই রায় কার্যকর হয়েছে। 

২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার মেম্বার হত্যা মামলার দুই আসামি-আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর ফাঁসি কার্যকর হয়। তারা চরমপন্থি দল পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। মৃত মুরাদ আলীর ছেলে মোকিম এবং মৃত আকছেদের ছেলে ঝড়ুর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারি ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে। 

আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির বুধবার বিকালে হাইকোর্টে তার নিজ চেম্বারে গণমাধ্যমকে জানান, হাইকোর্ট ফাঁসির আদেশ দিলে এর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালেই আপিল করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আসামিদের পরিবার দাবি করেছে ৪ বছর আগে ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে। হাইকোর্ট যখন তাদের ফাঁসির আদেশ দেন তখনই আমরা ২০১৩ সালে আপিল করে রাখি। দীর্ঘদিন পর আজকের (বুধবার) তালিকায় আসে মামলাটি, যেটি আপিল বিভাগের কার্য তালিকার ১১ নম্বরে আছে।’

তিনি বলেন, ‘মামলাটি যখন তালিকায় আসে, তখন আমরা আসামিদের পরিবারকে খবর দেই। আসামি মোকিমের স্ত্রী জানান, চার বছর আগেই ফাঁসি কার্যকর করেছে। তার আগে কারাগারে তারা শেষ সাক্ষাৎও করেছেন। ফাঁসি কার্যকরের পর লাশ এনে দাফনও করা হয়।’

ঘটনাটি আপিল বিভাগের দৃষ্টিতে এনেছিলেন কিনা-এমন প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আজকে (বুধবার) মামলাটি তালিকায় থাকলেও শুনানি হয়নি। যেদিন শুনানি হবে সেটি আদালতের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনব। ঘটনাটি যদি সত্যিই ঘটে থাকে তাহলে নিশ্চয় কারও না কারও ভুলে হয়েছে। বিষয়টি বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য আবেদন জানাবেন বলে জানান এই আইনজীবী।

অন্যদিকে ফাঁসি প্রসঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষ জানায়-সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই উল্লিখিত আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত আইজি প্রিজনস কর্নেল আবরার হোসেন বুধবার রাতে টেলিফোনে বলেন, যথাযথ নিয়মে যশোর কারাগারে দুই বন্দির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে তারা (আসামিপক্ষ) আপিল করেছিলেন। এরপর রিভিউ পিটিশন এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ভিক্ষা বা মার্সি পিটিশন পর্যন্ত সব আইনগত কার্যক্রম নেওয়া হয়। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে যথানিয়মে দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত দলিলপত্র কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত আছে। সুতরাং আপিল নিষ্পত্তির আগেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে বলে যে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে তা আদৌ সঠিক নয়। 

অতিরিক্ত আইজি প্রিজনসের উল্লিখিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফের মন্তব্য চাওয়া হলে বুধবার রাতে আসামিপক্ষের আইনজীবী হুমায়ুন কবির বলেন, আপিল নং ১১১/২০১৩ ও ১০৭/২০১৩ এখনও শুনানি হয়নি। বুধবার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ছিল। আপিল শুনানির আগেই দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে বলে আবারও দাবি করেন তিনি। 

মামলা থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন কুমারি ইউনিয়নের দুর্লভপুর এলাকার সাবেক মেম্বার মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার চাচাতো ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে।

পরে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ মামলার বিচারে তিনজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ, দুজনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেওয়া হয়।

পরে মোকিম (আপিল নং- ১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নং- ১০৭/২০১৩) মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন। তখন মোকিমের পক্ষে আপিল মামলাটি তদারকির দায়িত্ব পান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির। এরপর কেটে যায় আট বছর। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সম্প্রতি আপিল মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্য তালিকায় উঠেছে।

এদিকে যশোর ব্যুরো জানিয়েছে, খুলনা বিভাগীয় কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) মো. ছগির মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কারাগারে ২০১৭ সালে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে’-এমন খবর তাদের নজরেও এসেছে। কারা কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র-ফাইল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে।’ 

আপিল শুনানির আগে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনের নজরে আনা হয়। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি এখনও তেমন কিছু জানি না। না জেনে তো এ বিষয়ে বলা ঠিক হবে না।’

একই বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আপিল চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা এই প্রথম শুনলাম। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সেটা হবে আইনের চরম লঙ্ঘন। বিচার বিভাগের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা। এখন সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টির একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দিতে পারেন। কারা এতে জড়িত এবং কার নির্দেশে এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক সাজা কার্যকর করার আইনগত কোনো বিধান নেই। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করতে কয়েকটি আবশ্যকীয় আইনগত ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রথমত, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারামতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে। একইসঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১০ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়েরের বিধান রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাংবিধানিক অধিকারবলে আপিল বিভাগে সরাসরি আপিল দায়ের করতে পারেন। তৃতীয়ত, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ অনুযায়ী আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের আইনগত সুযোগ রয়েছে। সর্বোপরি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৯-এর অধীন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ওই ক্ষমার আবেদন নামঞ্জুর করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আইনগত বৈধতা লাভ করে।

সূত্র: যুগান্তর