শিরোনাম
চলতি সপ্তাহে বেলজিয়াম সফর শেষ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরকালে অন্যতম প্রধান যে বার্তাটি তিনি দিয়েছেন তা হলো, ইউরোপ ও চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নিচ্ছে না। যা তিনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারেও স্পষ্ট করেছেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি খুবই পরিষ্কার- 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়'। উন্নয়নের জন্য আমাদের বিনিয়োগ দরকার। ছোট্ট একটা দেশে ১৭ কোটি মানুষের বাস। তাই আমাদের সব দেশ থেকেই বিনিয়োগ প্রয়োজন। এখানে সবাই তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে পারে। আমরা শুধু মূল্যায়ন করি যে, এই বিনিয়োগ আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত কিনা।’
বেলজিয়াম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) থেকে ঋণ ও অনুদানসহ মোট ৪০ কোটি ইউরোর যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে তা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
‘গ্লোবাল গেটওয়ে’ উদ্যোগের অংশ ইউরোপ যে কয়টি বিনিয়োগ প্রকল্প চালু করেছে; এটা সেগুলোরই একটি। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পের মোকাবিলায় বিকল্প হিসেবে ২০২১ সালে নতুন এই উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম ছিল। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিদেশি সাহায্য, বিনিয়োগ ও সফল পোশাক রফতানি শিল্পের কল্যাণে বাংলাদেশ বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে আগামী জানুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্বাচনে আবারও প্রার্থী শেখ হাসিনা। এমন একটা সময়ে চলতি সপ্তাহে তার বেলজিয়াম সফর বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
কারণ এখন থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭৫ সালে যখন পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ তার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়, তখন এই বেলজিয়ামের রাজধানীতে বসেই মর্মান্তিক সেই খবর পেয়েছিলেন তিনি।
আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও আরও কয়েকটি দেশ। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট ওই দেশগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পলিটিকোর এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে সেই প্রতিশ্রুতিই পুনরায় ঘোষণা করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কারচুপির প্রশ্নই ওঠে না। তার দল আওয়ামী লীগই লড়াই-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বহু বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শেখ হাসিনার বেলজিয়াম সফরে ৪০ কোটি ইউরোর বিশাল বিনিয়োগ প্যাকেজটি ঘোষণা করেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন। এই প্যাকেজে সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে সৌর ও বায়ু প্রকল্পসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত।
প্রকল্পগুলোর অধীনে মোট ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাংলাদেশের উচ্চতা অনেক কম। যার ফলে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় এবং ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয় দেশটি। আবার নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দেয়া ইইউর ‘গ্লোবাল গেটওয়ে’ পরিকল্পনার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
তবে এই বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ স্বত্বেও এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে মোকাবিলা করতে ইউরোপকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে; তা এককথায় কঠিন। বেইজিংয়ের হিসাবে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ২৪১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১.৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে ৬৭০টিরও বেশি চীনা কোম্পানি কাজ করছে। স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ব্রিজ থেকে শুরু করে হাইওয়ে পর্যন্ত চীনের অর্থের প্রভাব বাংলাদেশজুড়ে দৃশ্যমান।
শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেন, ‘ঢাকা শুধু সর্বোচ্চ দরদাতাকেই হ্যাঁ বলে না। আমরা এটা সম্পর্কে খুব সতর্ক। কোনো প্রজেক্ট আমার দেশের জন্য উপযোগী কিনা, প্রজেক্ট শেষ হলে রিটার্ন কেমন হবে সেটা আমাকে বিচার করতে হবে। আমরা সবসময় প্রতিটি প্রকল্পের ক্ষেত্রেই এসব বিষয় বিবেচনায় রাখি।’
তবে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ব্রাসেলস থেকে পাওয়া বিনিয়োগ তাকে খুব একটা অভিভূত করেনি। তিনি বলেন, আমরা যেটা পেয়েছি সেটা বেশ ভালো একটা বিনিয়োগ। কিন্তু আমরা সবসময় আরও বেশি চাই। একবার আমরা যদি শুরু করতে পারি এবং সেটা বাস্তবায়ন করি, আমরা আরও বেশি পাব।’
শেখ হাসিনার কথার সারমর্ম হচ্ছে, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে মোকাবিলা করতে ইউরোপকে আরও বিনিযোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।