শিরোনাম
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অত্যন্ত সুরক্ষিত স্থাপনা কাস্টমস হাউজের অস্থায়ী গুদাম। সাধারণত যাত্রীদের কাছ থেকে জব্দ হওয়া সোনা ও অন্যান্য মালামাল সেখানে মজুত রাখা হয়। ডিজিটাল লকারের পাশাপাশি গুদামটি সার্বক্ষণিক পাহারা দেন কর্মকর্তারা। চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহি এর নিরাপত্তার দায়িত্বে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা থাকে সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি। এমন সুরক্ষিত স্থাপনা থেকে চুরি হয় ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। চুরি হওয়া এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জব্দ করা।
কাস্টমস হাউজ সংশ্লিষ্টরা জানান, অস্থায়ী গুদাম জব্দকৃত মালামালে পূর্ণ হওয়ায় গত শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) মালামাল সরানোর কাজ শুরু হয়। পর দিন শনিবার গুদাম থেকে মালামাল স্থানান্তর করতে গিয়ে দেখা যায় ভল্টের লকার ভাঙা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সোনা চুরির এ ঘটনা ঢাকা শুল্ক বিভাগের নজরে আসে গত শনিবার (২ সেপ্টেম্বর)। পরে এ ঘটনায় শুল্ক বিভাগ একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। সোনা চুরির ঘটনায় গতকাল রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাতে বিমানবন্দর থানায় ঢাকা শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় চারজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে উদ্ধার হওয়া ৪৮টি ডিএম বার, যার ওজন ৮ দশমিক ২ কেজি ও ২০২০ থেকে ২০২৩ সালে বিভিন্ন সময়ে জব্দ ৩৮৯টি ডিএম বার, যার মোট ওজন ৪৭ দশমিক ৪৯ কেজি ভল্টের লকার ভেঙে চুরি হয়েছে। গত শুক্রবার (১ সেপ্টম্বর) দিনগত রাত ১২টা ১৫ মিনিট থেকে শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের মধ্যে কে বা কারা বর্ণিত সোনার বারগুলো ও সোনার অলংকার গোডাউনের স্টিলের আলমারির লকার ভেঙে চুরি করেছে।
আরও জানা যায়, শনিবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মাসুদ রানা যুগ্ম কমিশনারকে বিমানবন্দরের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার কাছে শুল্ক বিভাগের গুদামের মূল্যবান পণ্যসামগ্রী রাখার একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা বলে জানান। মাসুদ রানা যুগ্ম কমিশনারকে আরও জানান, ২ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার রাত ১২টার পর) রাতে প্রতিদিনের মতো আটক পণ্য টিজিআর ১-এ জমা করে কাজ শেষে আনুমানিক রাত ১২টা ১৫ মিনিটে গোডাউনে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে চার কর্মকর্তা একসঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমস এলাকা ত্যাগ করেন।
মামলায় আরও বলা হয়েছে, গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমন সংবাদ পেয়ে ওই গুদাম পরিদর্শনে যান ঢাকা শুল্ক বিভাগের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার। তারা গিয়ে গুদামের একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা দেখেন। গুদামের পূর্ব পাশে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাতাস যে অংশ দিয়ে বের হয়, সেখানকার টিনের কিছু অংশ কাটা দেখতে পান। পরে তারা গুদামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সিপাহীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গুদামের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গুদাম থেকে কোনো মূল্যবান বস্তু চুরি হয়েছে কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য গুদামের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দেন।
বিমানবন্দরের ভেতরে ওই গুদামের দায়িত্ব পালন করেন চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সিপাহী। তাদের মধ্যে চার সরকারি রাজস্ব কর্মকর্তারা হলেন- মাসুদ রানা, সাইফুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও আকতার শেখ। চারজন সিপাহী হলেন- রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ মোকাদ্দেস বলেন, ইনভেন্ট্রি করে দেখা গেছে ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা মিসিং রয়েছে। এটা নিয়ে ব্যাপক তদন্ত হবে। এখানে কারও কোনো অবহেলা আছে কি না, অন্যায় আছে কি না সেটা বেরিয়ে আসবে। সব সংস্থাকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, চোর একটি প্যাকেটের সব সোনাই নিতে পারতো। কিন্তু সেখানে প্রতিটি প্যাকেট থেকে কিছু কিছু করে সোনার বার ও অলংকার সরানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ধাপে ধাপে সোনাগুলো সরানো হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনে গুদামের দায়িত্বে নিয়োজিত কাস্টমস হাউসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, চুরি যাওয়ার আলামত প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া যায়নি। গুদামে বাইরের কোনো ব্যক্তির প্রবেশেরও আলামত মেলেনি।
বিমানবন্দর এমনিতেই সংরক্ষিত এলাকা। যেখান থেকে সোনা চুরি হয়েছে, সেটি আরও নিশ্চিদ্রভাবে সংরক্ষিত। বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও সবাই সেই গুদামে যেতে পারেন না। এমন একটি স্থাপনা থেকে এভাবে বিপুল পরিমাণ সোনা চুরি যাওয়ার ঘটনা অনেকটাই অস্বাভাবিক। কাস্টমসে যারা কাজ করেন তারাই শুধু গুদামে প্রবেশ করেন।
জানা গেছে, এ ঘটনার তদন্ত করছে ঢাকা কাস্টমস হাউজের তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি অস্থায়ী গুদাম থেকে জব্দ সব সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ধারণা, একদিনে নয়, কয়েক দিন ধরে এ চুরির ঘটনা ঘটতে পারে। দুজন কাস্টমস কর্মকর্তা দুই বছর ধরে ওই গুদামে কর্মরত। যদিও এ কর্মকর্তার ছয় মাসের মধ্যে বদলির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের বদলির আদেশ পেয়েও ওই কর্মকর্তারা তা পালনে গড়িমসি করেন।