শিরোনাম
রাজধানীর চারপাশের ১১০ কিলোমিটার নৌপথে মিলছে একের পর এক লাশ। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে লাশ এনে সহজে নদীতে ফেলে যাচ্ছে অপরাধীরা। কারও পরিচয় মিলছে, কারও নাম-পরিচয় থেকে যাচ্ছে অজানা। ফলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ হয়ে উঠেছে লাশ গুমের ‘নিরাপদ অঞ্চল’।
নদীতে এমন লাশের সারির পেছনে নৌ-পুলিশের যথাযথ টহল ও নজরদারির অভাব রয়েছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এদিকে এই চার নদনদীর ঝুঁকিপূর্ণ ৫৬ স্থান শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে ২৫ স্থানে জরুরি ভিত্তিতে সিসিটিভি ও বাতি বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নদীতে আরও টহল বাড়াতে নৌ পুলিশে জনবল চেয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে দেওয়া হয়েছে চিঠি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ ও ঢাকার বিভিন্ন থানা সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ঢাকার চারপাশের নদীতে শতাধিক লাশ মেলে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গায় ৪৪, তুরাগে ১৪, শীতলক্ষ্যায় ২০ ও ঢাকার পাশের জেলার অন্য নদী থেকে আরও ৩০ লাশ উদ্ধার করা হয়।
নৌ পুলিশের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার চার নদী থেকে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০৫ লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩২টি, ২০২১ সালে ৩৮টি ও ২০২২ সালে ৩৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর (২০২২) সারাদেশের নদী থেকে ৩৬০ লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২৪০ লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হলেও ১২০টির পরিচয় জানা যায়নি। আর এ বছরের প্রথম তিন মাসে ৭৬ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হলেও ২১টির পরিচয় জানা যায়নি। আর ঢাকা অঞ্চল থেকে গত চার মাসে ১৮ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এই নৌপথের ঢাকার কেরানীগঞ্জ আঁটিবাজার অংশের বুড়িগঙ্গা থেকে গত ৬ নভেম্বর শাকিব (২০) নামের এক গাড়িচালকের লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন শাকিব। পরিবার সূত্রে জানা যায়, ভোলার চরফ্যাসনের দুলারহাট এলাকার কামাল হোসেন কয়েলের বড় ছেলে শাকিব। আগে চাকরি করলেও খুনের ৬ মাস আগে শ্বশুরের দেওয়া পিকআপ ভ্যান চালানো শুরু করেন তিনি। লাশ উদ্ধারের এক মাসের মাথায় শাকিব হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করে নৌ পুলিশের ঢাকা জোন।
হত্যার নেপথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মী মিজানুর রহমান, সিয়াম ও রিয়াজ গত ১ নভেম্বর শাকিবকে গাড়ি ভাড়ার কথা বলে ডেকে নেন। বাসায় নিয়ে তাঁকে দুই দিন আটকে রাখেন তাঁরা। পরে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ নভেম্বর রাতে শাকিবের হাত-পা ও মুখে স্কচটেপ সেঁটে জীবিত অবস্থায় বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয় ঘাতকরা। লাশ ফেলার তিন দিন পর বুড়িগঙ্গা নদীর কচুরিপানার ভেতর থেকে লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এ ঘটনায় শাকিবের চাচা জামাল হোসেন কেরানীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এক মাসের মাথায় হত্যায় জড়িত থাকার অপরাধে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে নৌ-পুলিশ ও র্যাব।
শাকিবের মতো একই পরিণতি হয় যশোরের মিনারুল ইসলাম (৪২) নামের আরেক গাড়িচালকের। এ ছাড়া গত ৩০ এপ্রিল বুড়িগঙ্গা থেকে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। তবে তাঁর পরিচয় এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। একইভাবে গত বছর বুড়িগঙ্গা থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় চিত্রনায়িকা রাইমা ইসলাম শিমুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, শিমুর স্বামী নোবেল নিজ বাসায় হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেন। এভাবে প্রতিদিনই কারোর না কারোর লাশ মিলছে ঢাকার চারপাশের নদীতে। অনেক লাশের পরিচয় মিললেও হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ফলে অধিকাংশ অপরাধী থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নদীতে লাশ ফেলার প্রবণতার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, নৌপথে এখনও নিরাপত্তার ঘটতি রয়েছে। অপরাধীদের যাতে কোনোভাবেই শনাক্ত করা না যায়, সে জন্য নদীতে লাশ ফেলার প্রবণতা বাড়ছে। অনেক সময় আঘাতের ধরন দেখলেও অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে লাশ পানিতে ফেললে সাধারণত ভেসে ওঠে না। আর উঠলেও পচে-গলে ওঠে। এতে লাশের অপরাধীর কোনো আলামত পাওয়া যায় না। এ ছাড়া লাশের (ভুক্তভোগী) শরীরে অপরাধীর আলামতও (ডিএনএ) নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে নদীকে টার্গেট করে অপরাধীরা লাশ ফেলে যাচ্ছে।
নৌপথে যথাযথ নজরদারি না থাকার কারণে অপরাধীরা নিরাপদে লাশ ফেলে যাচ্ছে উল্লেখ করে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, সব সময় অপরাধীরা নিরিবিলি স্থান বেঁচে নেয়। নদীর আশপাশের এলাকা নীরব থাকে। অনেক সময় ওসব এলাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির বাইরে থাকে। এই সুযোগ নেয় অপরাধীরা।
এদিকে নদীকেন্দ্রিক অপরাধীদের লাগাম টানতে জনবল ও সিসিটিভির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জানান ঢাকা জোনের পুলিশ সুপার (এসপি) গৌতম কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ঢাকা জেলায় রয়েছে দুটি থানা ও ১১টি নৌ ফাঁড়ি। ঢাকার আশপাশের নৌপথ নিরাপদ রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ ৫৬ স্থানে সিসিটিভি ও লাইট বসানো হবে। পাশাপাশি নদীতে টহল ও নজরদারি বাড়াতে থানা ও ফাঁড়িতে নৌযান সরবরাহ করার প্রক্রিয়া চলমান। এর মধ্যে সদরঘাট ফাঁড়ির জন্য ইঞ্জিনচালিত বোট কেনা হচ্ছে।’
এসপি গৌতম বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানে সিসিটিভি ও লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা পুলিশের একক বাজেটে সম্ভব নয়। এ জন্য চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের আশপাশের কারখানাসহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় সিসিটিভি ও লাইট লাগানো হবে। নির্জন স্থানে পুলিশের ব্যবস্থাপনায় লাগানো হবে। পরে এসব সিসিটিভি সম্মিলিতভাবে তদারকি করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, নদীতে লাশ ফেললে তাৎক্ষণিকভাবে ডুবে যায়। বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত নদীতে লাশ পড়লে দুই-তিন দিনের মধ্যে লাশ পচে-গলে এমন অবস্থা হয় যে আর শনাক্তের উপায় থাকে না। এ ছাড়া নদীতে এক স্থানে লাশ ফেললে অন্য কোনো স্থানে সেই লাশ ভেসে ওঠে। এতে করে অপরাধীর অবস্থান শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। মূলত লাশের পরিচয় ও ঘটনা আড়াল করতেই অপরাধীরা নদীতে লাশ ফেলছে।
নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন অ্যান্ড অপারেশন্স) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নৌ-পুলিশের বড় সফলতা হচ্ছে, আগে যে লাশ শনাক্ত করা যেত না তা এখন অনেকাংশে সম্ভব হচ্ছে। লাশ যখন শনাক্ত হয়ে যাবে, তখন নদীতে লাশ ফেলে অপরাধীদের গুম করার প্রবণতাও কমে আসবে। লাশ শনাক্ত হওয়ায় নদীকেন্দ্রিক অপরাধ প্রবণতাও আগের চেয়ে কমেছে।’