শিরোনাম
‘এক অ্যাপ এক দেশ, রিং আইডির বাংলাদেশ’ স্লোগানে ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম রিং আইডি। যাত্রা শুরু করলেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে এ পর্যন্ত একাধিক মামলা করেছেন গ্রাহকরা। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৫০০ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে শুরু হয় কমিউনিটি জবস অফার। তাদের সিলভার এবং গোল্ড দুই ধরনের ফাঁদে পা দেন অনেকেই।
সিআইডি বলছে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম রিং আইডি গত মে, জুন ও জুলাই মাসে হাতিয়ে নিয়েছে ২১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এসব টাকা জায়েজ করতে ও প্রতারণার মাধ্যমে আরও টাকা হাতিয়ে নিতে তারা নগদ-বিকাশের মতো মোবাইল ব্যাংকিং ‘রিং পে’ চালু করতে চেয়েছিল।
জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে রিং আইডি কমিউনিটি জবস মেম্বারশিপ চালু করে। মেম্বারশিপের মাধ্যমে এখানে বিনিয়োগ করে টাকা আয়ের সুযোগ দেওয়া হয়। এজন্য বর্তমানে দুটি প্যাকেজ অফার রয়েছে। সিলভার মেম্বারশিপ ও গোল্ড মেম্বারশিপ। সিলভার মেম্বারশিপের মূল্য ১২ হাজার টাকা এবং গোল্ড মেম্বারশিপের মূল্য ২২ হাজার টাকা। পাশাপাশি এখানে আরও দুটি প্রবাসী প্যাকেজ রয়েছে। প্রবাসী গোল্ড ২৫ হাজার টাকা এবং প্রবাসী প্লাটিনাম ৫০ হাজার টাকা। মেম্বারশিপ পাওয়ার পর বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ওই বিজ্ঞাপন যত গ্রাহক দেখেন তত টাকা আয় হয়।
এভাবে রিং আইডি কমিউনিটি জবস মেম্বারশিপের সিলভার প্যাকেজ থেকে প্রতিদিন ২৫০ টাকা এবং প্রতি মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা, গোল্ড মেম্বারশিপ থেকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা এবং প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
এছাড়া প্রবাসী গোল্ড মেম্বারশিপ থেকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা এবং প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা, প্রবাসী প্লাটিনাম প্যাকেজ থেকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা এবং প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা আয়ের সুযোগ আছে বলে অফার দেয় রিং আইডি।
এসব প্রলোভনের ফাঁদে পা দেন অনেকেই। যারা ইতোমধ্যে খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
সিআইডির একটি সূত্র বলছে, রিং আইডি তাদের প্রতারণার কৌশল হিসেবে বিকাশ অথবা নগদের মতো মোবাইল ব্যাংকিং চালু করতে চেয়েছিল, যাতে করে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করা খুব সহজ হয়। গ্রাহকদের বিভিন্ন প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তাদের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
রিং আইডির কয়েকজন ভুক্তভোগী গ্রাহক জানান, গোল্ড মেম্বারশিপ কেনার জন্য এক মাস আগে ২২ হাজার টাকা করে পেমেন্ট করেন তারা। অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু তাদের আইডি এখনো অ্যাকটিভ হয়নি। এ বিষয়ে তাদের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি। এভাবে মেম্বারশিপের নামে শত শত গ্রাহকের টাকা হাতিয়েছে রিং আইডি।
শুধু জবস মেম্বারশিপ দেওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। মেম্বারশিপ দিয়েও নানা ভোগান্তিতে ফেলা হয়েছে। এমন একটি সিস্টেম হলো ক্যাশ আউট। নিজের জমানো টাকা উঠাতে পারছেন না গ্রাহকরা। বিভিন্নভাবে এজেন্টের কাছে হয়রানির শিকার হয়েছেন তারা।
রিং আইডির জবস মেম্বারশিপ থেকে বিকাশ, রকেট ও নগদ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১০ দিন পরপর কমপক্ষে ২০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করা যাবে বলে বলা হয়। আর এজেন্টদের মাধ্যমে পেমেন্ট রিকোয়েস্ট দিয়ে এক থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তা পাওয়া যাবে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু সপ্তাহ প্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তোলার সুযোগ দিলেও কয়েকদিন পর রিং আইডি তা কমিয়ে দেয়। একসময় তারা ক্যাশ আউট অপশনই বাতিল করে দেয়। পরে তাদের অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যেই অনলাইন শপে জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তাদের অনলাইন শপে কয়েকগুণ বেশি মূল্যে পণ্য কিনতে হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার রিং আইডির অবৈধ কার্যক্রম সম্পর্কে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে তিন মাসে ২১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পায়। তাদের এসব সন্দেহজনক কার্যক্রম লক্ষ্য করে বেশ কিছুদিন আগে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার থেকে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) অনুসন্ধানের জন্য একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। বিএফআইইউ ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে।
রিং আইডি প্রাথমিকভাবে একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরে তারা বিভিন্ন সার্ভিস যোগ করে জনগণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করে। এসব সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে বিদেশে বিনিয়োগ, কমিউনিটি জবসসহ বিভিন্ন সার্ভিস, যার আড়ালে এ আমানত সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনা করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ এ খাতে বিনিয়োগ করে। এর আগেও তাদের করোনাকালীন ডোনেশনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহল সন্দেহ পোষণ করেছিল। বর্তমানে সন্দেহের তালিকায় থাকা বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটের মতো তারাও অস্বাভাবিক ডিসকাউন্টে বিভিন্ন প্রোডাক্ট বিক্রি ও ক্রেতাদের কাছ থেকে ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে লেনদেন পরিচালনা করছিল।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মাদ রেজাউল মাসুদ বলেন, ২০০ কোটি টাকার বেশি জায়েজ করার জন্য আরও অনেক প্রতারণার পরিকল্পনা ছিল রিং আইডির। যেমন- নগদ, বিকাশের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম (রিং পে) চালু করা, ই-টিকেটিং, ইভ্যালির মতো ই-কমার্স সাইট তৈরিসহ প্রতারণার মহাপরিকল্পনা ছিল তাদের। এই সবকিছুর মধ্যে মনে হয়েছে একটি অস্পষ্টতা রয়েছে তাদের।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি বিদেশে যেন টাকা পাচার করতে না পারে সেজন্য রিং আইডির সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রিং আইডি ইস্যুতে সাইবার পুলিশ সেন্টারে মানি লন্ডারিং বিষয়ে একটি অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান।
শুক্রবার (১ অক্টোবর) রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম রিং আইডির পরিচালক (সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার) করে সিআইডি। রিং আইডিতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন- এমন অভিযোগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একজনের করা মামলায় সাইফুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সূত্র: জাগো নিউজ