শিরোনাম
আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে সুনামগঞ্জের হাওরে আবারও ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাপাউবোর আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা ভারতের মেঘালয় ও আসাম প্রদেশে ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এই সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে দ্রুত পানি বাড়তে পারে, যার প্রভাব দ্বিতীয়বারের মত পড়বে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে।
শনিবার বাপাউবোর পূর্বাভাসের বরাত দিয়ে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম জানান, সুনামগঞ্জে সব হাওরের ফসল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ চাষিরা সতর্ক অবস্থায় বাঁধ রক্ষায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
তিনি বলেন, গত তিন দিনে ঢলের পানি হাওরের কাচা বাঁধগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমরা প্রতিটি বাঁধকেই মনিটরিংয়ের আওতায় রেখে বাস্তবায়নকারী পিআইসিসহ স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছি। আমরা বাঁশ, বস্তাসহ আপৎকালীন বাঁধ রক্ষায় বিভিন্ন জিনিস সরবরাহ করে রেখেছি। আমাদের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই প্রকৌশলী জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় দেখা গেছে, সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা ও পুরাতন সুরমাসহ সব নদ-নদীর পানি কিছুটা কমছে। এ সময় সুরমার পানি ৫.১৯ মিটার, যাদুকাটার পানি ৪.৬০ মিটার আর পুরাতন সুরমার পানি ৪.৬৬ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, দেশের হাওর এলাকায় মোট ৯৬টি হাওর রয়েছে। এ পর্যন্ত ছয়টি হাওরে ও চারটি বিলে ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে টাঙ্গুয়ার ও চাপতির হাওর হচ্ছে বড়, বাকিগুলো ছোট হাওর। এখনো প্রধান ও বড় হাওরগুলো নিরাপদে আছে। সেখানে এখনো ঢলের পানি প্রবেশ করেনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল হাওর এলাকা পরিদর্শনে গেছে। আগাম বন্যার ফলে হাওরের ফসলের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সরেজমিন দেখা ও দিকনির্দেশনা দিতে তারা দিনভর স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত কয়েক দিনের ঢলে হাওরের সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির ফসলে পানি প্রবেশ করেছে। এর অর্ধেক ফসলও নষ্ট হলে আর্থিক হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ কোটি টাকা।
শুক্রবার সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমলচন্দ্র সোম বিভিন্ন উপজেলায় হাওর ঘুরে দেখেছেন।
তিনি বলেন, “কৃষক নদীতে পানির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখে আতঙ্কিত। বাস্তব কারণে এখনও সুনামগঞ্জের সব হাওরের ফসল ঝুঁকির মুখে আছে। তবে যদি এক সপ্তাহ ভারি বৃষ্টি না হয় তাহলে কৃষক ফসল কাটতে শুরু করতে পারবে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য ঢল মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চার হাজার হেক্টর আয়তনের চাপতির হাওরে বাঁধ ভেঙে ঢলের পানিতে সব ফসল তলিয়ে গেছে। হাওরগুলোর ভূপ্রকৃতি অনেকটা ভাতের থালার মতো। মানে একবার পানি প্রবেশ করলে সেখান থেকে আর পানি বের করা যায় না। ফলে যা ফসল থাকে, তার বড় অংশের ক্ষতি হয়।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বর্তমানে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৯টি নদ-নদীর পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করছে। এর মধ্যে মাত্র দুটির পানি বাড়ছে, বাকিগুলোর কমছে। যেসব অঞ্চলে বাঁধ ভেঙেছে, সেখানে মূলত নদী ও হাওরের সীমানা রক্ষাকারী বাঁধগুলো চুইয়ে ও ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে।
হাওরপাড়ের মন্দিয়াতা গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক সানজু মিয়া জানান, হাওরে ব্যাপকভাবে পানি বাড়ছে। শুক্রবার সকালে প্রথমে বাঁধের পাশের কান্দা উপচে হাওরে পানি ঢুকে, পরে বাঁধটি ভেঙে যায়।
গত এক সপ্তাহ ধরে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পায়। এতে ঝুঁকিতে পড়ে জেলার সব হাওরের বোরো ফসল।
প্রথমে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যায়। এরপর একে একে আরো হাওরের ফসলহানি ঘটে।
এ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১১টি হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটেছে। পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত থাকায় এখন জেলার সব হাওরের ফসলই ঝুঁকির মুখে রয়েছে। অনেক বাঁধে ধস ও ফাটল দেখ দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোডের্র (পাউবো) কর্মকর্তা বলছেন, উজানের (ভারতের চেরাপুঞ্জি) বৃষ্টিই ভয়ের মুল কারণ। সুনামগঞ্জ তেমন বৃষ্টি নেই। ঢল নামা অব্যাহত আছে। তবে পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে উন্নতি হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ২২০ মেট্রিক টন।
তাদের হিসাব মতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলায় বিভিন্ন হাওরে ফসলহানি চার হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির। তবে হাওর আন্দোলনের নেতারা বলছেন ক্ষতির পরিমাণ আট থেকে ১০ হাজার হেক্টর হবে।
সূত্র: দেশ রূপান্তর