যুদ্ধাবস্থায় ইউক্রেনে জাহাজ পাঠানো নিয়ে প্রশ্ন

ফানাম নিউজ
  ০৪ মার্চ ২০২২, ০৫:৩৭

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। ২২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। যুদ্ধ আসন্ন জেনেও এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশি জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধিকে পণ্য পরিবহনের জন্য পাঠানো হয় ইউক্রেনে। ইউক্রেনে জাহাজটি পৌঁছানোর পরদিন ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। আর সাত দিনের মাথায় ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশি ওই জাহাজে গোলার আঘাতে একজন নাবিকের মৃত্যু হয়।

যুদ্ধের প্রস্তুতি চলার সময় ইউক্রেনে কেন পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশি ২৯ জন নাবিকসহ জাহাজটি পাঠানো হলো, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। গত বুধবার বিকেলে জাহাজটিতে হামলায় একজন নাবিকের মৃত্যুর পর ঝুঁকির মুখে আছে আরও ২৮ নাবিকের জীবনও। দুর্ঘটনার আগে-পরে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) এমন দায়িত্বহীনতার বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসছেন সাবেক নাবিকেরা।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, যুদ্ধাবস্থা আছে এমন দেশ বা বন্দরে যেতে বাধ্য নয় জাহাজের মাস্টার বা মালিক বা ব্যবস্থাপনাকারী। এ ক্ষেত্রে চার্টারের (জাহাজ ভাড়া নেওয়া প্রতিষ্ঠান) নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে না।

নাবিকদের জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে চাইলে সেখানে না যাওয়ার নির্দেশনা দিতে পারত বিএসসি। যুদ্ধাঞ্চলে গিয়ে একজন নাবিক নিহত হয়েছেন। ২৮ জন নাবিকের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

বিএসসির নতুন এই জাহাজ ডেনমার্কের ডেলটা করপোরেশনের কাছে তিন মাসের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ভাড়া দিলেও জাহাজটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে সংস্থাটি। জাহাজে কর্মরত নাবিকদের সবাই বাংলাদেশি।

একাধিক ক্যাপ্টেন জানান, যুদ্ধাবস্থা চলছে এমন এলাকায় জাহাজ না পাঠানোর এখতিয়ার জাহাজমালিক হিসেবে বিএসসির ছিল। আবার জাহাজের মাস্টারেরও একই এখতিয়ার রয়েছে—জাহাজ মালিক বা চার্টারের (যিনি ভাড়া নেন) নির্দেশ উপেক্ষা করার। সমুদ্রে নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তাবিষয়ক কনভেনশন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য সেফটি অব লাইফ এট সি বা সোলাস’-এর পঞ্চম অধ্যায়ের ৩৪ ধারায় জাহাজের মাস্টারকে এই স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এ কনভেনশনের অনুশাসন মেনে চলে। আবার যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ভাড়ার চুক্তি হয়েছে, সেখানেও যুদ্ধাবস্থায় কী করতে হবে বা কী করতে হবে না, তা উল্লেখ থাকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্যিক) পীযূষ দত্ত বলেন, ‘তুরস্ক থেকে ইউক্রেনে যাওয়ার আগে ডেলটা করপোরেশন আমাদের ইউক্রেনে যাওয়ার কথা জানিয়েছিল। আমরা জাহাজের বিমাকারী প্রতিষ্ঠানকে তা জানিয়েছি। তারা বলেছে, ভাড়া নেওয়া প্রতিষ্ঠান যুদ্ধঝুঁকির প্রিমিয়াম পরিশোধ করে সেখানে যেতে পারবে। এরপর বিষয়টি ডেলটা করপোরেশনকে জানানোর পর তারা প্রিমিয়াম পরিশোধ করে ইউক্রেনে পণ্য বোঝাইয়ের জন্য রওনা হয়।’

বিএসসির অনুমতি পেয়েই গত ২১ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ইরাগলি বন্দর থেকে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের দিকে রওনা হয় জাহাজটি। অলভিয়া বন্দরে সিরামিকের কাঁচামাল ক্লে বা কাদামাটি বোঝাই করে ইতালির একটি বন্দরে নেওয়ার কথা ছিল জাহাজটির। জাহাজটি ২২ ফেব্রুয়ারি অলভিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়। এরপর প্রায় ৬০ নটিক্যাল মাইল সরু চ্যানেল পেরিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে অলভিয়া বন্দরের অদূরে নোঙর করে জাহাজটি। রাত না পেরোতেই পরদিন ভোরে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হয়।

যুদ্ধ শুরু এবং বন্দর কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণার পর বিএসসি জাহাজটিকে ফেরত আসার নির্দেশ দেয় জাহাজের মাস্টারকে। কিন্তু বিএসসির সেই নির্দেশ মানার সুযোগ ছিল না মাস্টারের। কারণ, অলভিয়া বন্দরের অনুমতি ছাড়া জাহাজ বন্দর এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। বন্দর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অনুমতি পাওয়া যায়নি। আবার জাহাজ চলাচলের পথে পানির নিচে মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে—এমন সংবাদও ছিল মাস্টারের কাছে। তাই মাস্টার সেই নির্দেশ পালন করতে পারেননি।

বিএসসি কেন এমন ঝুঁকি নিয়েছে জানতে চাইলে পীযূষ দত্ত জানান, চুক্তিতে যুদ্ধাঞ্চলে যেতে পারবে না এমন বিষয় ছিল না। যুদ্ধঝুঁকির প্রিমিয়াম পরিশোধ করে যেতে পারার বিষয় ছিল। আবার জাহাজের মাস্টারও বুঝতে পারেনি, এত দ্রুত যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। প্রথমত যাওয়ার আগে যুদ্ধ ছিল না। আবার এক-দুই দিনের মাথায় হামলা হবে, তা কেউ ধারণা করতে পারেনি।

বিএসসির বহরে এই জাহাজ যুক্ত হয় ২০১৮ সালের শেষে। জাহাজটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে আসছে বিএসসি। জাহাজটিতে মাস্টার হিসেবে রয়েছেন ক্যাপ্টেন জি এম নুর ই আলম।

সূত্র: প্রথম আলো