এখনো অবিকশিত বিমা খাত

ফানাম নিউজ
  ০১ মার্চ ২০২২, ১১:৪৪

অনেক সম্ভাবনার বিমা খাত এখনো অনিয়ন্ত্রিত ও অবিকশিত। এ খাতের মাধ্যমে মানুষকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব। ব্যাংকের মাধ্যমে বিমা পলিসি চালু অর্থাৎ ব্যাংকানস্যুরেন্স চালুর মাধ্যমে প্রিমিয়াম আয় দ্বিগুণ করা যায়, কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা এ ব্যাপারে শুধু কথাই বলে যাচ্ছেন। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

মোবাইলে ১০০ টাকা ফ্লেক্সি করলে ১০ টাকা যদি প্রিমিয়াম আকারে কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়, তাতে সমাজের বড় একটা অংশকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব।

তৃতীয় পক্ষের যে মোটরবিমা ২০১৮ সালে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, তা আবার চালু করেও সংগ্রহ করা সম্ভব অন্তত বছরে তিন হাজার কোটি টাকা। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব জীবন তহবিলের টাকায়।

বিমা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব সম্ভাবনা দেখছেন। কিন্তু সরকার প্রতিবছর ছোট ছোট বিমা পণ্য চালু করলেও সমাজের বেশিসংখ্যক মানুষকে ছুঁয়ে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। আবার প্রচার–প্রচারণার ঘাটতি এবং এ খাতের কিছু কোম্পানির অনিয়মের কারণে বিমা খাত নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে একধরনের অনাস্থা।

হতাশার এ চিত্র সামনে নিয়েই আজ ১ মার্চ মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আয়োজনে দেশব্যাপী জাতীয় বিমা দিবস পালনের আয়োজন করা হয়েছে। মূল অনুষ্ঠান হচ্ছে ঢাকার আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে অনলাইনে এ দিবসের উদ্বোধন করবেন। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘বিমায় সুরক্ষিত থাকলে, এগিয়ে যাব সবাই মিলে।’

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ।

বিমা খাতের অমিত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে যথাযথ নীতি পদক্ষেপ নেওয়ার অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিভাগটির নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর কাছে গতকাল জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার স্মৃতি ধরে রাখতেই আজকের দিনটিকে জাতীয় বিমা দিবস ঘোষণা করে সরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে ব্যাংকের চেয়েও বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেশি। ব্যাংক আছে ৬১টি, বিমা আছে ৮১টি।

আওয়ামী লীগ সরকার কয়েক দফায় উদার হস্তে বিমা কোম্পানির লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু আর্থিক খাতের মধ্যে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার যেভাবে এগিয়ে গেছে, বিমা খাত সেভাবে পারেনি। অথচ বঙ্গবন্ধুর চাকরিজীবনের সঙ্গে এ বিমা খাত জড়িত।

বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘বিমা খাতকে এগিয়ে নিতে যথাযথ নীতি পদক্ষেপের অভাবটাই বড় সংকট। পুরো খাতটি অবিকশিত অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারের সুদৃষ্টি থাকলে আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই বিমা খাত তার সক্ষমতা দেখাতে পারবে।’

দুর্নীতি ও আস্থার সংকট

বিমা খাতে দুর্নীতির অভিযোগ বরাবরই ছিল। আরও ছিল বিমা দাবি পরিশোধ না করার। ছিল কমিশন প্রথার অপব্যবহার। এসব অভিযোগ এখনো আছে। একদিকে কারখানায় আগুন লাগিয়ে বিমা দাবি করার অভিযোগ আছে, আরেক দিকে আছে পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গ্রাহকদের পাওনা বুঝিয়ে না দেওয়ার। আরও আছে কর ফাঁকি ও ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ।

জীবনবিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডেল্টা লাইফ ও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ দুটি বড় কোম্পানি। দুর্নীতির কবলে পড়ে দুটি কোম্পানিই এখন খারাপ অবস্থায় আছে।

বিমা খাতের আরেক বড় সমস্যা আস্থার সংকট। এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা তুলনামূলক কম। জীবনবিমার পলিসি বিক্রি করা হয় এখনো পুরোনো পদ্ধতিতে। মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা টাকা পাবেন, এ ধারণার সঙ্গেই অনেক মানুষ একমত নন। মানুষ চায় বেঁচে থাকতে কীভাবে জীবনের ঝুঁকি কমানো যায়।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কমিশন প্রথার অপব্যবহার কমছে। আর দুর্নীতির অভিযোগ ও অনাস্থা বরাবরই ছিল। বিমা দাবি পরিশোধ না করারও একটা প্রবণতা আছে কিছু কোম্পানির। আমরা চেষ্টা করছি পুরো বিমা খাতকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে আনতে। এটা করা গেলে খাতটি অনেকটাই শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।’

দুর্বল নিয়ন্ত্রক সংস্থা

বিমা খাতকে গুরুত্ব দিতেই বিমা অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে সরকার ২০১১ সালে গঠন করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (আইডিআরএ)। কিন্তু সংস্থাটিতে নেই পর্যাপ্ত জনবল। ফলে ১১ বছর ধরে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি চলছে অসম্পূর্ণভাবে।

সংস্থাটির মধ্যম পর্যায়ে প্রেষণে বিমা খাতের বাইরের লোক নিয়োগ দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করে আসছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি (লাইফ সদস্য ও নন–লাইফ সদস্য) পদ খালি চার থেকে পাঁচ বছর ধরে। অবসরপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মচারী বিমা বিষয়ে অভিজ্ঞ থাকলে এত দিনে এ দুই পদও শূন্য থাকত না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

দেশের ৬১টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে সাত হাজারের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী। আর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৩০০ জনের কাছাকাছি, আর আইডিআরএর জনবল মাত্র ৫০ জন, যাঁরা আবার চাকরি না থাকার অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।

এ বিষয়ে মেঘনা লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেহারা এমন দীনহীন হতে পারে না, যে চেহারা আইডিআরএর। এ সংকটটাই আমার কাছে বড় মনে হয়।’

বিমা খাতের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটি শিশু জন্মের পর থেকেও বিমা করা যায়, আমাদের এখানেও তা সম্ভব। আর এটা ঠিক, বিমা পণ্য বিক্রিতে আমরা এখনো মান্ধাতার যুগেই আছি। তবে ইউরোপের বিমাপণ্য ও এগুলো বিক্রির ধরন অনুসরণ করে একটু একটু বদলাচ্ছি।’

সূত্র: প্রথম আলো