শিরোনাম
দিনের বেলা আকাশে মেঘ নেই। নেই কুয়াশাও। অথচ সূর্যের দেখা মিলছে না। পাশের দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লির আকাশ এখন আবছা অন্ধকারে ঢাকা। দূষণে ছেয়ে গেছে পুরো শহর। যেন অন্ধকার জনপদে রূপ নিয়েছে।
এর আগেও দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই শহর। এবার অবস্থা আরও ভয়াবহ। কূল মিলছে না। স্কুল-কলেজ বন্ধ। ৫০ শতাংশ মানুষ অফিস করতে পারছেন। বাকিদের ঘরে থেকে কাজ সারতে বলা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারও।
প্রশ্ন হচ্ছে—ঢাকা থেকে দিল্লি কতদূর? ঢাকার বাতাসে কী মিলছে? মুক্তি, নাকি অচিরেই দূষণে ছেয়ে যাবে ঢাকার আকাশও। ঢাকার পরিস্থিতিও ভয়াবহ বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব। আর অতিসত্বর রাজধানী স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগরবিদ অধ্যাপক ড. শামসুল হক।
দিল্লির দূষণ ও ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয় এই দুই বিশেষজ্ঞের কাছে।
অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘ঢাকা প্রায় মৃত নগরী। রাজধানী ঢাকার উন্নয়ন মূলত ডিকটেটেড উন্নয়ন। চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন দিয়ে জনকল্যাণ হয় না। বরং জনগণকে মৃত্যুর ফাঁদে ফেলা হয়। এখন তা-ই হচ্ছে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘দূষণের এই নগরী এখন কোমায় আছে। অক্সিজেন দিয়ে কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়তো। কিন্তু কখনোই আর সুস্থ-স্বাভাবিক হতে পারবে না। অপরিকল্পিত উন্নয়ন করে ঢাকার সর্বনাশ করা হয়েছে বহু আগে। এখন রাজধানী স্থানান্তর ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
স্থপতি ইকবাল হাবিব ঢাকার দূষণ নিয়ে মতামত জানিয়ে বলেন, ‘ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম বায়ু দূষণের শহর। আবার আজ থেকে চার বছর আগে বাংলাদেশের আরেকটি শহর রাজশাহী পৃথিবীর দ্রুততম বায়ু দূষণ কমিয়ে আনার শহর হওয়ার প্রমাণ দিয়েছে। অর্থাৎ একটি দেশেই দুই ধরনের উদাহরণ তৈরি হয়েছে। তার মানে আমরা কার্যকরণ জানি, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করছি না।’
‘অজ্ঞতা ও নির্বিকারবোধ থাকায় ঢাকা শহর আজ দূষণের শহরে রূপ নিয়েছে। দূষণে আমরা দিল্লির কাছাকাছি না হলেও বেশি দূরে নেই। আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ১৭০ থেকে ১৮০ মাত্রার দূষণ থাকে। এই মাত্রা অবশ্যই সিরিয়াস। এমন সিরিয়াস দূষণ থাকার পরও আমরা নির্বিকার থাকার মানে হচ্ছে—আমরা আমাদের জীবনকে, প্রজন্মকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।’
দূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘আমরা পাঁচ বছর আগে ঢাকার ফার্মগেট এলাকার পাঁচটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছিলাম যে, ৩৭ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফুসফুস শ্বাস-প্রশ্বাসে সক্ষমতা হারাচ্ছে। কী ভয়াবহ! এই সক্ষমতা হারানোর বিষয় যদি আপনি না জানেন, তাহলে আপনার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ করবে না। দুঃখবোধও নেই। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোনো সতর্কতা নেই। জরিপ নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। যে তথ্য মিলছে তা বিক্ষিপ্তভাবে। কিন্তু সেই তথ্যও অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা নিজেদের আড়াল করে বাঁচার চেষ্টা করছি মাত্র।’
‘আর এ কারণে বায়ু দূষণজনিত রোগ, অসুস্থতা মারাত্মকভাবে বাড়ছে। সাড়ে চার বছর আগে এক জরিপে চিকিৎসকরা বলেছিলেন, প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ ফুসফুসজনিত রোগী বাড়ছে এবং সেটা বায়ু দূষণের কারণেই’—যোগ করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।
বায়ু দূষণের কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বায়ু দূষণের সুস্পষ্ট চারটি কারণ বের করেছে। প্রথমত, মানহীন গাড়ি থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ কার্বন নিঃসরণ ও যানজটের কারণে তার মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়া; দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সারা বছর ধরেই নির্মাণ কাজ চালানো; তৃতীয়ত, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্লাস্টিক, চামড়া বা বর্জ্য পোড়ানো। আর শেষ কারণ হচ্ছে পুরো ঢাকাকে ঘিরে অসংখ্য ইটভাটার দূষণ।’
‘যে কয়েকটি কারণের কথা বললাম, তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পদ্ধতিগতভাবে সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন একটি প্রস্তাব পাস করার জন্য। সাবের হোসেন চৌধুরী সংসদে প্রস্তাব রাখলেও তা আজও পাস হয়নি। তার মানে সব জানার পরও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি নিয়ে আমরা কোনো উদ্যোগ নেই না। আর এ কারণে ক্ষতিটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।’
‘ঢাকা শহর একটি মুমূর্ষু শহর। ঢাকার দূষণের মাত্রা এই মুহূর্তে ১৫৪ থেকে ১৬০ মাত্রায়। ঢাকার পাশের শহর গাজীপুরের অবস্থা আরও খারাপ। সেখানকার মাত্রা ১৮০। এখানে প্রাণ বাঁচে রোগ আর অসুস্থতাকে সঙ্গে নিয়েই’—যোগ করেন এই পরিবেশ বিশ্লেষক।
সূত্র: জাগো নিউজ