শিরোনাম
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বর্ষা-মঙ্গল’ কাব্যে লাবণ্যস্নিগ্ধ রূপবতী বর্ষাকালকে নিয়ে লিখেছেন, ‘ওগো সন্ন্যাসী, কী গান ঘনাল মনে।/গুরু গুরু গুরু নাচের ডমরু/বাজিল ক্ষণে ক্ষণে।/তোমার ললাটে জটিল জটার ভার/ নেমে নেমে আজি পড়িছে বারম্বার/বাদল আঁধার মাতাল তোমার হিয়া,/বাঁকা বিদ্যুৎ চোখে উঠে চমকিয়া।’
বর্ষার বন্দনায় কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘গ্রীষ্ম চলিল, বর্ষা আসিল, আষাঢ়ে নামিল ঢল;/বুনো পাখি সব ডাকে অবিরল: ‘বাওয়া ক্ষেত কর তল।’/এই তো কখন নেমেছে বৃষ্টি, অবিরাম তবু ঝরছে;/না পেয়ে উপায় রাখালের দল ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছে।’
ঝড়-বৃষ্টি এবার শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগে। কিন্তু ঋতুচক্রের খেলায় বর্ষারানি হাজির হলো। আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। বাদল দিন আবার তার নূপুরের শব্দ শোনাল। কদম, কেতকী ধোয়া বৃষ্টিস্নাত দিন বাঙালির জীবনের হয়তো নিয়ে আসবে নতুন কোনো বারতা। বর্ষা মানেই আবেগ, অনুভূতির জোয়ার। এ জোয়ারে ভাসেননি এমন কবি-সাহিত্যিক পাওয়া যায় না। শুধু যে কবি-সাহিত্যিক, তা নয়-সাধারণ মানুষও। কালীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বা নির্মলেন্দু গুণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ-কেউ বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিনে বর্ষা এক বিপুল বিস্ময় নিয়ে আবির্ভূত।
আষাঢ় ও শ্রাবণ-দুই মাস বর্ষাকাল। আর বর্ষাকাল মানেই মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, জেগে ওঠার গান। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাই তো বলেছেন, ‘এই জল ভালো লাগে;- বৃষ্টির রুপালি জল কত দিন এসে/ধুয়েছে আমার দেহ-বুলায়ে দিয়েছে চুল-চোখের উপরে/তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,-আবেগের ভরে।’ বর্ষা আমাদের মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। পুরোনো জঞ্জাল ধুয়েমুছে আমরাও জেগে উঠি প্রাণচাঞ্চল্যে।
বর্ষা আমাদের জন্য অপরিহার্য এক ঋতু। বৃষ্টি না হলে শস্যাদি জন্মাবে না, বেড়ে উঠবে না প্রাণ। বৃষ্টির অভাবে মাটি যখন অনুর্বর হয়ে যায়, তখন বর্ষা এসে তা উর্বর করে। আমাদের নদী, মাঠ, ঘাটের দেশ বর্ষায় ভরে ওঠে সবুজে-শ্যামলে। বর্ষার পানিতে নদীনালা, খালবিল ভরে ওঠে। সেখানে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। তাই বর্ষা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। এক পশলা বৃষ্টি যে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে জীবনে, তা অন্যকিছুতেই পাওয়া যায় না।
বর্ষায় বাংলার নদনদী পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। নদীর ফেঁপে ওঠা জোয়ারের পানি প্রচুর পলি জমায় মাটিতে, যা নিয়ে আসে শস্যের প্রাচুর্যের খবর। এ সময় বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা-শালুক। হিজল আর কেয়াফুলের অরূপ দৃশ্য মোহিত করে মনকে।
বর্ষাকাল গ্রামের মানুষকে অনেক বেশি ঘরমুখো করে তোলে। রমণীরা ঘরে বসে নকশিকাঁথায় ফুল তোলে। অনেকটা আলস্যে কেটে যায় দিন। বৃষ্টি বেশি হলে গরিব মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না।
বর্ষায় ফোটে কদম ফুল, যা বর্ষার রূপকে বাড়িয়ে দেয়। আরও ফোটে কেতকী। শহরের একঘেয়ে যান্ত্রিক জীবনে বর্ষা কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে। বৃষ্টি শহরের ধুলোবালিকে বশ করে। তবে বর্ষায় শহরের রাস্তাঘাট অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়, যা মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। অতি বর্ষণে দেখা দেয় নদীভাঙন ও বন্যা। যা ইতোমধ্যেই দেশে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলার কৃষি ও অর্থনীতি বৃষ্টিনির্ভর। যথাযথ বৃষ্টিপাত ফসল ফলাতে সহায়তা করে। অন্যদিকে অনাবৃষ্টি ও খরায় কৃষি ভেঙে পড়ে। তাই বর্ষাকাল আমাদের জীবনে সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্ষা উৎসব : বর্ষা উৎসব উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে প্রতিবছরের মতো এবার বর্ষা উৎসব-১৪২৯ তথা আষাঢ়স্য প্রথম দিনের আয়োজন করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক পরামর্শ কেন্দ্রের (টিএসসি) ভিতরে সবুজ চত্বরে। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে অনুষ্ঠানের সূচনা হবে যন্ত্র সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। বর্ষাকথন পর্বে অংশগ্রহণ করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সাহিত্যিক ও গবেষক ড. হায়াৎ মামুদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন বর্ষা উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট, সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনের সভাপতি নৃত্যশিল্পী, লেখক ও গবেষক অধ্যাপক ড. নিগার চৌধুরী। আয়োজনে প্রতীকীভাবে ধরিত্রীকে সবুজ করার লক্ষ্যে শিশু-কিশোরদের মাঝে বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা বিতরণ করা হবে।
এ উৎসবে একক সঙ্গীত পরিবেশন করবেন মহাদেব ঘোষ, প্রিয়াংকা গোপ, অনিমা রায়, তানভির সজিব, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, রত্না সরকার ও নবনীতা জাইদ চৌধুরী। একক আবৃত্তি পরিবেশন করবেন- আহকামউল্লাহ, মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল ও নায়লা তারাননুম চৌধুরী কাকলি, দলীয়নৃত্য পরিবেশন করবেন স্পন্দন, নৃত্যাক্ষ, সুরবিহার, নিক্কন পারফরমিং আর্ট সেন্টার ও নৃত্যজন। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবেন-বহ্নিশিখা, স্ব-ভূমি লেখকশিল্পী কেন্দ্র, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, পঞ্চভাস্কর, সুরবিহার ও সুরসাগর ললিতকলা একাডেমি।