শিরোনাম
অনেকেই বাবর আজমের নেতৃত্বাধীন বর্তমান পাকিস্তানের সঙ্গে ৯২’র ইমরান খান বাহিনীর মিল খুঁজে পাচ্ছেন। বলছেন, ২৯ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ইমরান খানের নেতৃত্বে যেভাবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান, তেমনি আড়াই যুগ পর বাবর আজমের অধিনায়কত্বে এই পাকিস্তানও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতবে।
ইমরান খানের অধিনায়কত্বে পাকিস্তান সেবার ৫০ ওভারের ফরম্যাটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবার ফরম্যাট ভিন্ন। তবে ভিন্ন ফরম্যাটেই দোর্দণ্ড প্রতাপ বজায় রেখে চলছে পাকিস্তানিরা। গ্রুপ পর্বে একমাত্র অপরাজিত দল হিসেবে সেমিতে উঠে এসেছে বাবর-রিজওয়ানরা।
সুপার টুয়েলভ পর্বে কোনও দল পাকিস্তানের পথে বাধা হতে পারেনি। সব প্রতিকূলতাকে অনায়াসে অতিক্রম করে শেষ চারে পাকিস্তান। অনেকে তাই ইমরানের বিশ্বকাপজয়ী দলের সঙ্গে বাবর আজমের বাহিনীর সাযুজ্য খোঁজার চেষ্টা করছেন। তাদের ধারণা, আবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বড়সড় সাফল্য পেতে যাচ্ছে পাকিস্তান।
বাবর আজমের নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ আর প্রায় চল্লিশের ঘরে পা রাখা মোহাম্মদ হাফিজ ও শোয়েব মালিকের গড়া পাকিস্তান দল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সত্যিই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় কি-না, সময়ই দেবে সেই উত্তর। তার আগে আজ বড় পরিক্ষার মুখে পাকিস্তান। সেমিফাইনালে দলটিকে টপটাকে হবে অস্ট্রেলিয়া বাধা।
এই বাধা পেরিয়ে বাবর আজমের দল ফাইনালে উঠে চ্যাম্পিয়ন হোক বা না হোক, ৯২’র বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানের সাফল্যর গল্পের সঙ্গে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পাকিস্তানের কিন্তু আসলে কোনও মিল নেই। দুই দলের পথচলায় আছে বিস্তর ফারাক।
এবার যেমন শুরু থেকেই দুরন্ত-দুর্বার পাকিস্তান, ৯২’র পাকিস্তান কিন্তু ততটা অপ্রতিরোধ্য ছিল না। ইতিহাস বলছে, ওই আসরে পাকিস্তান সেমিতে উঠেছিল খুঁড়িয়ে চলে, চার নম্বর দল হিসেবে। বরং ৯২’র বিশ্বকাপে দারুণ খেলে প্রায় সবাইকে হারিয়ে এক নম্বর দল হিসেবে শেষ চারে পা রেখেছিল নিউজিল্যান্ড।
৯ দেশের অংশগ্রহণে ওই বিশ্বকাপের রবিন লিগে ৮ ম্যাচে মাত্র একবার হার মেনেছিল মার্টিন ক্রোর নিউজিল্যান্ড। বাকি ৭ ম্যাচে ব্ল্যাক ক্যাপসদের শৌর্যবীর্যের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিন আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়ে।
অ্যালান বোর্ডারের নেতৃত্বে ডেভিড বুন, জিওফ মার্চ (বর্তমান অসি ওপেনার মিচেল মার্শের পিতা), ডিজন জোন্স, টম মুডি, স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহ, ক্রেইগ ম্যাকডরমেট, ইয়ান হিলি এবং পিটার টেলরের সাজানো তারকায় ঠাঁসা ও প্রবল শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে ৩৭ রানে হারিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সেবার নিউজিল্যান্ড। তারপর একে একে শ্রীলঙ্কা (৬ উইকেট), দক্ষিণ আফ্রিকা (৭ উইকেট), জিম্বাবুয়ে (৪৮ রান), ওয়েষ্ট ইন্ডিজ (৫ উইকেট), ভারত (৪ উইকেট) ও ইংল্যান্ডকে (৭ উইকেট) হারিয়ে সবার ওপরে থেকে সেমিতে উঠে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় মার্টিন ক্রোর নিউজিল্যান্ড।
বিপরীতে অনেক চড়াই-উৎরাই, কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ ৪ চারে পা রাখে পাকিস্তান। মাঠের পারফরম্যান্স ছাড়াও সেই আসরে ‘ভাগ্য’ ইমরান খানের দলটিকে দারুণ সহায়তা করে। না হয় সেমিফাইনালে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না দলটি পক্ষে।
রবিন লিগের এক ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হয়ে নিশ্চিত পরাজয়ের হাত খেকে বেঁচে যায় পাকিস্তান। মাত্র ৭৫ রানের ছোট টার্গেট নিয়ে ব্যাটিংয়ের নামা ইংলিশরা মাত্র ৮ ওভার (১ উইকেটে ২৪) ব্যাট করার পর চলে আসে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে আর একটি বলও হয়নি। খেলা পণ্ড হয়ে যায়। তাতে করে দুই দল এক পয়েন্ট করে পায়। নিশ্চিত হারা ম্যাচে এক পয়েন্ট পেয়ে যায় পাকিস্তানিরা।
রবিন লিগের শেষ ম্যাচে আকাশে উড়তে থাকা দুরন্ত নিউজিল্যান্ডের জয়রথ থামিয়ে ৭ উইকেটের জয় পাওয়ার পরও পাকিস্তান সেমিফাইনালে পৌঁছায় বেশ কিছু ‘যদি-কিন্তু’ ওপর ভর করে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে পাওয়া ১ পয়েন্ট আর সবাইকে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলে সবার ওপরে থাকা কিউইদের শেষ ম্যাচে হারানোর পর পাকিস্তানের পয়েন্ট দাঁড়ায় ৮ খেলায় (৪ জয় ও ৩ পরাজয় এবং পরিত্যক্ত ম্যাচে এক পয়েন্ট সহ) ৯।
শেষ দিকে পাকিস্তানের সেমিতে ওঠা নির্ভর করছিল ওয়েষ্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের ফলের ওপর। ৭ খেলার ৪টিতে জেতা ওয়েষ্ট ইন্ডিজ অস্ট্রেলিয়ার সাথে শেষ খেলায় জিতলেই পাকিস্তান বাদ পড়ে যেত। তখন রিচি রিচার্ডসন বাহিনীর পয়েন্ট দাঁড়াতো ৮ খেলায় ১০। তাতে করে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিতে খেলত ওয়েষ্ট ইন্ডিজ।
কিন্তু শেষ ম্যাচে অসিদের কাছে ক্যারিবীয়রা ৫৭ রানে হেরে যাওয়ায় কপাল খুলে যায় ইমরানের দলের। চার নম্বর দল হিসেবে সেমিতে ওঠে পাকিস্তান এবং সেই ম্যাচে ইনজামাম উল হকের অবিস্মরণীয় উইলোবাজি (৩৭ বলে ৬০) আর ফাষ্টবোলার ওয়াসিম আকরাম (২/৪০) ও লেগস্পিন গুগলি বোলার মুশতাক আহমেদের স্পিন ঘূর্নিতে (২/৪০) নিউজিল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় পাকিস্তান।
তারপর ফাইনালে মেলবোর্নে অধিনায়ক ইমরান খানের ৭২ রানের সংগ্রামী ইনিংস, লেগি মুশতাকের (৩/৪১) এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা বাঁহাতি ফাষ্টবোলার ওয়াসিম আকরামের (৩/৪৯) একজোড়া এক্সপ্রেস ডেলিভারির ওপর ভড় করে টান টান উত্তেজনা ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনালে গ্রাহাম গুচের ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে ওয়ানডের বিশ্বসেরা হয় পাকিস্তান।
কাজেই টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের এবারের পথ পরিক্রমার সাথে ৯২’র ওয়ানডে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার চালচিত্র বা পথচলার কোনও মিল খোঁজা বোকামি। বরং ২৯ বছর আগে নিউজিল্যান্ড যে জায়গায় ছিল, পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় ৯০ ভাগ সেরকম।
সেই বিশ্বকাপে আসরে রবিন লিগে নিউজিল্যান্ড ৮ ম্যাচের ৭ টিতে জিতে মানে ৯০ শতাংশ সাফল্য নিয়ে সেমির যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে। আর এবার পাকিস্তান গ্রুপ পর্বে ১০০ ভাগ সাফল্য দেখিয়ে শেষ চারে।
৯২’র সেই নিউজিল্যান্ডের পরিণতি হবে না তো?
ক্রিকেট অভিধানে ‘ল অফ অ্যাভারেজ’ বলে একটি কথা আছে। যার ভাবার্থ হলো অনেকগুলো ম্যাচ এক লয়, ছন্দে খেলা যায়না। টানা ভালো খেলার পর একটি ম্যাচ খারাপ যায় বা খারাপ কাটে। পুরো আসরে অনেক বেশি গাণিতিক, সাজানো গোছানো, ছকে বাঁধা ক্রিকেট খেলেছে পাকিস্তান। বাবর আজম যা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বাবরকে তার ওপেনিং সঙ্গী মোহাম্মদ রিজওয়ানও দারুণ সঙ্গ দিচ্ছেন। আর দুই বর্ষীয়ান যোদ্ধা শোয়েব মালিক এবং মোহাম্মদ হাফিজ হাল ধরেছেন ঠিক জায়গা মতো। সঙ্গে তরুণ সেনসেশন আসিফ আলীর উত্তাল উইলোবাজি ও ছক্কা বৃষ্টি এবং ফাষ্টবোলার শাহিন শাহ আফ্রিদির ধারালো বোলিং-সব মিলে এখন পর্যন্ত প্রায় নির্ভুল ক্রিকেট খেলেছে পাকিস্তানিরা।
সুপার টুয়েলভ পর্বে বাবর-রিজওয়ান-হাফিজ-মালিক-আসিফ শাহিন, কেউ না কেউ ঠিক সময়ে ব্যাট ও বল হাতে জ্বলে উঠে কাজের কাজ করে দিয়েছেন। ফাইনাল নির্ধারনী ম্যাচেও তারা নিশ্চয়ই সামর্থের সবটুকু নিংড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু ওই যে ‘ল অফ অ্যাভারেজ।’ তার খপ্পরে পড়ে যদি আজ সত্যিই একটি খারাপ দিন যায় পাকিস্তানের? যাবেই যে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তবে যদি এসে যায় এবং খারাপ দিন মানে কোনও কিছুই পক্ষে না আসে তবে কি হবে?
তখন কিন্তু ৯২’র ইমরানবাহিনী নয় বরং মার্টিন ক্রোর নিউজিল্যান্ডই বনে যাবে পাকিস্তান !
দেখা যাক আজ বৃহষ্পতিবার ওয়ার্নার-ফিঞ্চদের সাজানো-গোছানো কঠিন প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মাঠের খেলায় কী ঘটে, কী করে পাকিস্তান।