শিরোনাম
আবদুর রাজ্জাক পরামর্শটা দিতে বেশি শব্দ নিলেন না। ঢাকা থেকে হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর এক বাক্যের কথা, ‘এ রকম পরিস্থিতি সামলানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে চুপ থাকা।’
রাজ্জাক কোন পরিস্থিতির কথা বললেন এবং চুপ থাকার পরামর্শটা কাদের দিলেন, সেটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারও। পরিস্থিতি বলতে এই যে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের দুরবস্থা নিয়ে পাল্টাপাল্টি সমালোচনার ঝড় বইছে, সেটা। আর তিনি চুপ থাকতে বলেছেন কিছুদিন আগেও যাঁদের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুমে থেকেছেন, সেই ক্রিকেটারদের। তাঁর চোখে ক্রিকেটারদের সমালোচনাগুলোকে ইতিবাচকভাবেই নেওয়া উচিত।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল একের পর এক হতাশাই উপহার দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো সুপার টুয়েলভের দুই ম্যাচেই হেরে বাংলাদেশের চেয়েও কম নেট রানরেট অর্জন করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শারজায় খেলতে নামার আগেও আজ ভালো কিছু আশা করাটা তাই দুঃসাহস দেখানোর মতো মনে হচ্ছে।
এ রকম সময়ে আর সব বাদ দিয়ে খারাপ খেলার কারণ খুঁজে বের করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোচ–খেলোয়াড়েরা মিলে সেটা হয়তো করছেনও। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম, সাবেক ক্রিকেটার এবং ক্রিকেট বোর্ডের সমালোচনার জবাবে পাল্টা ঢিল ছুড়তে পথে নেমে গেলেন, সেটাই বিপদ।
সমালোচনার জবাব খেলোয়াড়েরা সব সময় দিয়ে এসেছেন ব্যাট–বলের পারফরম্যান্স দিয়ে। এবার সেটি না করে তাঁরা নিজেরাই সমালোচনার মহাসড়কে নেমে গেছেন ‘পিকেটিং’ করতে! এখন তো এই কাজে কারও কারও পরিবার–পরিজনও সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। সব জায়গা থেকে এমন অসহিষ্ণুতার আগুন ছড়িয়ে পড়লে কে কাকে থামাবে, কে কাকে বোঝাবে?
বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই নতুন ‘সংস্কৃতি’ ভালো লাগছে না জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান আকরাম খানের। দলের সঙ্গে জৈব সুরক্ষাবলয়ে না থাকলেও বিশ্বকাপ উপলক্ষে এখন তিনি দুবাইয়ে। বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান হিসেবে জাতীয় দলের ভালো–মন্দের সঙ্গে আকরামের সম্পৃক্ততা সরাসরি। কাল সেই আকরাম খানের কণ্ঠেই হতাশা, ‘বিশ্বকাপে অনেক দলই খেলছে। তাদের সবার মনোযোগ কিন্তু মাঠ আর খেলার মধ্যে। একমাত্র আমাদের দলই দেখলাম মাঠের বাইরের কথাবার্তায় মনোযোগ দিচ্ছে। দলের ওপর এটার নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে।’
বাংলাদেশ দলের যা পারফরম্যান্স, তা নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক মনে করেন আকরাম খান। সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করেন, এই খেলোয়াড়েরাই ভবিষ্যতে আবার দেশকে জয়ের আনন্দে ভাসাবে। সমালোচনার অর্থ এই নয় যে পৃথিবী এখানেই শেষ।
প্রথম পর্বে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হারটা অপ্রত্যাশিত ছিল বাংলাদেশ দলের কাছে। পরের ম্যাচে ওমানের বিপক্ষে জয়ও খুব সহজে আসেনি। আর স্কটল্যান্ড, ওমান, পাপুয়া নিউগিনির মতো দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়টাই স্বাভাবিক ঘটনা। তবু প্রথম পর্বের শেষ দুই ম্যাচ জয়ের পর বাংলাদেশ দল থেকে যে রকম প্রতিক্রিয়া এসেছে, তাতে মনে হয়েছে এই দুই জয় তাদের কাছে ‘অসামান্য’ কিছু। ওমান, পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে বিশ্বকাপে বুঝি বড় কিছুই করে ফেলেছে বাংলাদেশ! এরপর তো সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে এসেও কথার ছুরি চালালেন মুশফিকুর রহিম, দিলেন আয়নাতত্ত্ব।
সব মিলিয়ে এই উপলব্ধিটাই আসছে যে প্রতিপক্ষের বোলিং–ব্যাটিংয়ের চেয়ে দল নিয়ে কে, কোথায়, কী বললেন; ক্রিকেটাররা যেন সেসবের জবাব দিতেই বিশ্বকাপে এসেছেন! খেলোয়াড়দের এই মানসিকতা অবাক করছে আকরাম খানকে, ‘স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আমরা হেরেছি। ওমানের বিপক্ষেও প্রথম ১২ ওভার পর্যন্ত অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ছিলাম। এগুলো তো দলের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না!’ তাঁর উল্টো মনে হচ্ছে, বাজে খেলার পরও সমালোচনা তুলনামূলক কমই হয়েছে, ‘খেলোয়াড়েরা ভালো খেললে সবাই তাদের মাথায় তুলে রাখবে, খারাপ খেললে খারাপ বলবে। এটা মেনে নিয়েই ওদের খেলতে হবে। বিশ্বের কোনো খেলোয়াড়ই এর বাইরে নয়।’
বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে সবকিছুতে ক্রিকেটারদের এমন অতি প্রতিক্রিয়া দৃষ্টিকটুই লাগছে। বিশেষ করে যাঁরা এই প্রতিক্রিয়াগুলো দেখাচ্ছেন, তাঁরা সবাই দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। অনেক উত্থান–পতন পেরিয়েই তাঁদের এ পর্যন্ত আসা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এতগুলো বছর খেলে ফেলার পরও যদি তাঁরা মাঠের বাইরের চাপ নিতে না পারেন, মাঠের চাপ নেবেন কীভাবে!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় দলের এক সাবেক অধিনায়কের পর্যবেক্ষণ, ‘আমাদের ক্রিকেটাররা গালির চেয়ে তালিই বেশি শোনে। তারপরও তাদের এমন প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠার কারণ বুঝতে পারছি না। খেলোয়াড়েরা সাধারণত যত বড় ও অভিজ্ঞ হয়, তত বিনয়ী হয়। ওরা কেন সে রকম হচ্ছে না, এর ব্যাখ্যা পাচ্ছি না। অবশ্য উল্টোটাও হতে পারে। বয়স হচ্ছে বলেই হয়তো ওদের ধৈর্য কমে যাচ্ছে।’
জৈব সুরক্ষাবলয়ের মধ্যে থাকলেও বাইরের কথাবার্তা ক্রিকেটারদের কানে এবার একটু বেশিই যাচ্ছে। হোটেল থেকে বের হওয়ার উপায় নেই বলে খেলা–অনুশীলনের বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তাদের সময় কাটছে বেশি। আর এই মাধ্যমটিতে কেউ যত বেশি সময় থাকবে, ততই সে অন্যের ভাবনাচিন্তার জালে জড়িয়ে যাবে। এখন বিষয়টা আপনার ওপর, অন্যের ভাবনাগুলোকে আপনি কীভাবে নেবেন অথবা আদৌ নেবেন কি না। নির্বাচক রাজ্জাক যেমন বললেন, ‘সব কথায় কান না দিয়ে কী করলে ওদের ভালো হবে, দলের ভালো হবে, খেলোয়াড়দের শুধু তা নিয়েই চিন্তা করা উচিত।’
সেটাই আসলে পারে সমালোচনাকে শক্তিতে পরিণত করতে। জেদ থেকেও তখন হতে পারে ভালো কিছু।
সূত্র: প্রথম আলো