শিরোনাম
২০১৮ বিশ্বকাপের আগে-পরে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারটা সম্ভবত দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। সেই বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত নেইমার মানে ছিল নির্মল শিশুতোষ আনন্দ নিয়ে ফুটবল খেলা। কিন্তু রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে ‘ডাইভিং’ বিতর্কের পর গত কয়েক বছরে ব্রাজিলিয়ান মহাতারকার ক্যারিয়ার যেন অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। যে মোড়ের পর ফুটবলে সাফল্যের চেয়ে চোট আর বিতর্কের উপস্থিতি বেশি।
পেশাদারি খোলস আর টানা ফুটবলের ক্লান্তির মধ্যেও এখনো নেইমারের ফুটবলে মনের আনন্দের ছাপ পাওয়া যায়, কিন্তু কেন যেন অবিসংবাদিত বিশ্বসেরাদের সারিতে নেইমারের উপস্থিতিটা নিয়মিত নয়। সময়ের সেরাদের আলোচনায় লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের নাম যেভাবে এসেছে, নেইমারের নাম গত কয়েক বছরে সে আলোচনা থেকে আরও দূরে সরেছে।
বয়স ২৯ হয়ে গেছে বলে ভবিষ্যৎ সেরাদের আলোচনায়ও তাঁর নাম সেভাবে আসে না। কিলিয়ান এমবাপ্পের পাশাপাশি এখন সেখানে আলোচনায় থাকে আর্লিং হরলান্ডের নাম।
অনেক কিছুর সম্ভাবনা জাগিয়ে শুরু ক্যারিয়ারে তাই অপ্রাপ্তিই নেইমারের সঙ্গী হয়েছে বেশি। সেই অপ্রাপ্তি ঘোচানোর সুযোগও কি কমে আসছে, বিশেষ করে ব্রাজিলের জার্সিতে?
খেলা সম্প্রচারমাধ্যম ডিএজেডএনে নেইমারের সাক্ষাৎকারের পর ব্রাজিল সমর্থকদের সে উদ্বেগ ঘিরে ধরতে পারে। নেইমার যে বলছেন, ২০২২ বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। ফুটবলপ্রেমীদের উদ্বেগে ভাসাবে নেইমারের অন্য কথাটিও। পিএসজির ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড বলছেন, ফুটবল থেকে মনই উঠে যাচ্ছে তাঁর!
‘আমার মনে হয় এটিই (২০২২ কাতার) হতে যাচ্ছে আমার শেষ বিশ্বকাপ। আমি এটিকেই আমার শেষ বিশ্বকাপ ভাবছি, কারণ আমার মনে হয় না ফুটবলকে আর সহ্য করার মতো মনের জোর অবশিষ্ট আছে আমার’—ডিএজেডএনের বিশেষ তথ্যচিত্র ‘নেইমার অ্যান্ড দ্য লাইন অব কিংস’-এ বলেছেন ব্রাজিলিয়ান মহাতারকা।
সময়ের সেরাদের একজন নেইমারকে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের মঞ্চ পেয়েছেই মাত্র দুবার। ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিলেই আয়োজিত বিশ্বকাপে দারুণ খেলতে থাকা নেইমারের বিদায়টা হয়েছিল নিদারুণ কষ্টে। কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার হুয়ান জুনিগার ভয়ংকর ট্যাকলে মেরুদণ্ডের হাড়ে চোট পেয়েছিলেন নেইমার।
কতটা ভয়াবহ সেই চোট, সেটি ‘প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’-এ পরে জানিয়েছিলেন নেইমার। ডাক্তাররা তখন তাঁকে বলেছিলেন যে জুনিগার হাঁটুর আঘাতটা আর দুই ইঞ্চি বাঁয়ে হলেই আর ফুটবলই খেলা সম্ভব হতো না নেইমারের! সেই বিশ্বকাপে নেইমারকে ছাড়া খেলতে নেমে সেমিফাইনালে জার্মানির হাতে বড় লজ্জা পেয়েছে ব্রাজিল।
সেই চোট কাটিয়ে ফেরা নেইমার ২০১৮ বিশ্বকাপে এসেছিলেনই চোটের ছায়া নিয়ে। আগের মৌসুমেই বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে যাওয়া নেইমার ফেব্রুয়ারিতে ডান পায়ের মেটাটারসালে চোট পান। যে চোট সারিয়ে তাঁর বিশ্বকাপে খেলাই সংশয়ে ছিল।
সংশয় কাটিয়ে রাশিয়ায় সেই বিশ্বকাপে নেইমার খেলেছেন বটে, কিন্তু সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি। বরং চোটের ভয়টা মনে খুব বেশি করে গেঁথে বসেছিল বলেই কি না, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার ট্যাকল করতে এলেই নিজেকে বাঁচাতে নেইমারের মাটিতে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা চোখে লেগেছে। এবার কোয়ার্টার ফাইনালেই বাদ পড়েছে ব্রাজিল।
দুবারে হয়নি, কিন্তু এরপর আর একবারই বিশ্বকাপ জয়ের চেষ্টা করবেন নেইমার? ২০২২ বিশ্বকাপের সময় তাঁর বয়স থাকবে ৩০, সে হিসাবে ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডার আয়োজনে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে তাঁর খেলা একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু নেইমারের ফুটবলেই যেন অরুচি ধরে যাচ্ছে।
হয়তো ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ‘সৃষ্টিশীলতা’র প্রমাণ রাখা একের পর এক টুর্নামেন্ট আর টানা ম্যাচ খেলার ধকল এর কারণ। কারণ হতে পারে তাঁকে নিয়ে চলা নিরন্তর সমালোচনাও। কারণ যা-ই হোক, নেইমার জানিয়ে দিচ্ছেন, বিশ্বকাপ খুব বেশিবার আর পাবে না তাঁকে।
আর যে একবার পেতে পারে, সেটিতে অবশ্য ব্রাজিলের ষষ্ঠ আর নিজের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপার জন্য প্রাণপণে লড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন নেইমার, ‘নিজের সেরা অবস্থায় বিশ্বকাপে যেতে সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব আমি। আমার দেশকে জেতাতে, ছোটবেলা থেকে আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা সত্যি করতে সম্ভব সবকিছুই করব। আশা করি সেটা করতেও পারব।’
না পারলে? ব্রাজিলের জার্সিতে শূন্যতায়ই বিদায়ের শঙ্কা থাকবে নেইমারকে ঘিরে। বিশ্বকাপ তো জিততে পারেননি, ব্রাজিলের হয়ে কোপা আমেরিকাও জেতা হয়নি নেইমারের। ভাগ্যটাই খারাপ বলতে হবে নেইমারের। ব্রাজিলের জার্সিতে তাঁর অভিষেকের পর যে একবার কোপা আমেরিকা জিতেছে ব্রাজিল, চোটের কারণে সে কোপা আমেরিকার দলে ছিলেন না নেইমার! এখন পর্যন্ত ব্রাজিলের মূল দলের জার্সিতে তাঁর অর্জন বলতে শুধু ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপই।
পরের কোপা আমেরিকা আসতে আসতেও ২০২৪ সাল লেগে যাবে। তত দিন পর্যন্ত ফুটবলে মন থাকবে নেইমারের?
সূত্র: প্রথম আলো