শিরোনাম
আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের নিকটি শীতকাল ভীষণ প্রিয়। কেননা অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এই সময়ে ইবাদত বেশি করা যায় এবং সহজভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মোমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ: ১১৬৫৬) অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মোমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে।’ (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি: ৩৯৪০)
তীব্র শীতের রহস্য
শীত-গ্রীষ্ম সবই মহান আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টির বিচিত্র রূপ। রাত-দিনের পরিবর্তন, ঋতুবৈচিত্র্য এবং সৃষ্টির অনুপম নৈপুণ্যতা সবই মহান আল্লাহর মহিমা। ঋতুর পরিবর্তনে শীত ও গ্রীষ্ম আসে। একসময় তীব্র শীত আবার একসময় তীব্র গরম অনুভূত হয়। শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা আসে জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম তার প্রতিপালকের কাছে অভিযোগ করে বলে, হে প্রতিপালক, আমার এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তাকে দুটি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি প্রদান করেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে, আর একটি গ্রীষ্মকালে। কাজেই তোমরা গরমের তীব্রতা এবং শীতের তীব্রতা পেয়ে থাকো।’ (বুখারি, হাদিস : ৩০৮৭)
শীতের তীব্রতায় জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা
শীতের তীব্রতা জাহান্নামের শীতলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাজেই তীব্র শীতে জাহান্নামের কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করা উচিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো বান্দা তীব্র শীতের সময় বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই), আজকের দিনটি কতই না শীতল। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে জামহারির জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন। তখন আল্লাহ জাহান্নামকে লক্ষ্য করে বলেন, আমার এক বান্দা তোমার জাহান্নাম থেকে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। আমি তোমাকে সাক্ষ্য রেখে বলছি, আমি তাকে মুক্তি দিলাম।’
সাহাবিরা বলেন, জামহারির কী? জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, ‘জামহারির জাহান্নামের এমন একটি ঘর, যেখানে কাফিরদের নিক্ষেপ করা হবে। শীতের তীব্রতায় তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে।’ (আস-সিলসিলাতুদ-দায়িফাহ, হাদিস : ৬৪২৮)
শীতকালে গাছের পাতা ঝরে পড়ার দৃষ্টান্ত
শীতকালে গাছের পাতা ঝরে পড়ে। শীতের শেষ দিকে গাছপালার সব পত্র-পল্লব শূন্য হয়ে যায়। গুরুত্বসহকারে নামাজ আদায় করলে নামাজির পাপগুলোও এভাবে ঝরে যায়। আবু জার গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত মুহাম্মদ (সা.) শীতকালের কোনো একদিন বের হলেন, যখন গাছের পত্র-পল্লব ঝরে পড়ছিল। তিনি গাছের দুটি ডাল ধরলেন, ফলে পাতাগুলো আরো বেশি ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, ‘হে আবু জার,’ আমি বললাম, আমি উপস্থিত, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, ‘কোনো মুসলমান বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করে, তখন তার পাপগুলো এই গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২১৫৯৬)
শীতকাল ইবাদতের বসন্তকাল
শীতকাল মুমিনের জন্য অনন্য আশীর্বাদ। অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে অনেক বেশি ইবাদত করা যায়। রাত লম্বা হওয়ায় অনেক সময় ধরে রাতে নামাজ আদায় করা যায়। আবার দিন ছোট ও আরামদায়ক হওয়ায় সহজে রোজা পালন করা যায়। এ জন্যই হাদিসে শীতকালকে মুমিনের বসন্তকাল বলা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শীতকাল মুমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১১৭৩৪)
শীতকালে যেসব আমল সহজেই করতে পারি-
এক. শীতকালের রোজা রাখা
রোজা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নেকি লাভের অন্যতম মাধ্যম। শীতকালের রোজায় স্বল্প সময় ব্যয় হয়। সুতরাং শীতকাল রোজা পালনের মোক্ষম সুযোগ। এ জন্য শীতকালের রোজাকে বিনা পরিশ্রমে নেকি লাভের মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমির ইবনে মাসউদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘শীতকালের রোজা হচ্ছে বিনা পরিশ্রমে যুদ্ধলব্ধ মালের অনুরূপ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৭)
পূর্বে উদ্ধৃত হাদিস থেকে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট। শীতকালে দিন থাকে খুবই ছোট এবং ঠাণ্ডা। ফলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে যেমন থাকতে হয় না, তেমনি তৃষ্ণার্ত হওয়ারও ভয় নেই। সুতরাং কারো যদি কাজা রোজা বাকি থাকে, তবে এটাই হলো সেগুলো আদায় করে নেয়ার মোক্ষম সুযোগ। তাছাড়া বেশি বেশি নফল রোজা রাখারও এটি সুবর্ণ সময়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে যে ব্যক্তি একদিন রোজা রাখল, আল্লাহ তায়ালা প্রতিদানস্বরূপ জাহান্নাম এবং ওই ব্যক্তির মাঝখানে ৭০ বছরের দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (বোখারি: ২৮৪০, মুসলিম: ১১৫৩)
অতএব শীতের এই মওসুমে বেশি বেশি রোজা রাখা উচিত। বিশেষত- আইয়ামে বিজ তথা হিজরি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারের রোজা।
দুই. তাহাজ্জুদ পড়া
শীতকালে রাত অনেক লম্বা হয়। কেউ চাইলে পূর্ণরূপে ঘুমিয়ে আবার শেষরাতে তাহাজ্জুদ পড়তে সক্ষম হবে। একদিকে ঘুমের যেমন কোনো কমতি হবে না অন্যদিকে মহান একটি ইবাদত আদায়ের পবিত্র অভ্যাস গড়ে উঠবে। আল্লাহ তায়ালা মোমিনদের সম্বন্ধে বলেন, তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। (সূরা সেজদাহ: ১৬) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত। (সূরা আয যারিয়াত: ১৭)
তিন. পূর্ণরূপে ওজু এবং নামাজের অপেক্ষা
শীতকালে সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। পানি বরফের মতো হয়ে যায়। কাজেই ওজু করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে এশা ও ফজরের নামাজের জন্য ওজু করা খুবই কষ্টকর হয়। শীতের তীব্রতায় কষ্টের কারণে আল্লাহ তায়ালা নেকির মাত্রাও বাড়িয়ে দেন। শীতে পরিপূর্ণভাবে ওজু করা অনেক নেকির কাজ। উপরন্তু এর আকর্ষণীয় প্রতিদান রয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেন, আমি কি তোমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দিবো না; যার কারণে আল্লাহ তাআলা পাপ মোচন করবেন এবং জান্নাতে তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন? সাহাবিগণ বললেন, হ্যাঁ আল্লাহর রাসূল! নবীজি বললেন, মন না চাইলেও ভালোভাবে ওজু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা। (মুসলিম: ২৫১)
চার. কাপড় দান করা
দুনিয়ার বহু অঞ্চলে নির্যাতিত মুসলমানগণ শরণার্থী শিবিরে কিংবা নিজদেশে আর্থিক অসচ্ছলতা হেতু মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঠাণ্ডা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদের নিকট পর্যাপ্ত কাপড়ের ব্যবস্থা নেই। শীতের আমেজে আমরা উষ্ণ পোশাক পড়ে যখন শীতকে উপভোগ করি, তখন লাখো মানুষ একটু উষ্ণতার জন্য জুবুথুবু হয়ে খড়কুটো জ্বালিয়ে জীবনটাকে টেনে নিয়ে যায়। মানবিক এবং ইসলামিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ওইসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো বিত্তবানদের ওপর জরুরি। শুধু বিত্তবান নয়, সাধারণ মানুষও সাধ্যমতো এগিয়ে আসতে পারেন।
একজন মুসলমানকে কাপড় দান করার কী ফজিলত- সে বিষয়ে রাসূল (সা.) বলেন, যে মোমিন অপর বিবস্ত্র মোমিনকে কাপড় পরিয়ে দিল আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তিকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরিয়ে দিবেন। (সুনানে তিরমিজি: ২৪৪৯, মুসনাদে আহমাদ: ১১১১৬) কোনো বর্ণনায় এসেছে: আল্লাহ তাকে জান্নাতি পোশাক পরিয়ে দিবেন। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, ২/৯২)
পাঁচ. শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো
শীত নিবারণের মতো পোশাক-পরিচ্ছদ সব মানুষের থাকে না। খাদ্য-পুষ্টি ও বাসস্থানের অভাবে অনেকেই শীতে মানবেতর জীবন-যাপন করে। সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানের দাবি।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুমিন যদি অন্য কোনো মুমিনের ক্ষুধায় অন্ন জোগায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল আহার করাবেন। কোনো মুমিন যদি অন্য কোনো মুমিনের পিপাসায় পানি পান করায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সিল করা জান্নাতি পানীয় পান করাবেন। কোনো মুমিন যদি অন্য কোনো বস্ত্রহীন মুমিনকে পরিধান করায়, তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরিধান করাবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৪৯)
পরিশেষে বলা যায়, শীতকালে নতুন কিছু ইবাদত করার সুযোগ তৈরি হয়, কিছু ইবাদত পালন করা সহজ হয় এবং কিছু ইবাদতে কষ্ট বৃদ্ধির কারণে নেকির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কাজেই শীতকালকে বিরক্তিকর বা অসহনীয় মনে না করে; বরং ইবাদত করে নেকির পাল্লা ভারী করার চেষ্টা অব্যাহত রাখাই ঈমানের পরিচয়।