শিরোনাম
হালাল-হারাম ইসলামের এক অনন্য অলঙ্ঘনীয় বিষয়। জীবিকা উপার্জনের ইসলাম অনুমোদিত মাধ্যমগুলোর অন্যতম হলো ব্যবসা।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী। অর্থনৈতিক চরম মন্দার সময়ও তিনি ছিলেন বহুগুণ মুনাফা অর্জনকারী সফল ব্যবসায়ী। যখন পৃথিবীর সব ব্যবসায়ীই লোকসান হতো তখনও তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সততা দিয়ে প্রচুর লাভ অর্জনের চমক দেখানো যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্রয়-বিক্রয় ব্যয়সায় অভিহিত হওয়ার জন্য শর্ত হলো তা হতে হবে সম্পূর্ণ হালাল পন্থায়। হালাল-হারামের সীমা অতিক্রম করলেই তা আর ব্যবসা থাকে না বরং তা হয়ে যায় প্রতারণা।
হালাল ব্যবসার শর্তগুলোর অন্যতম হলো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি। ব্যবসার জন্য শর্ত রয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টির। অর্থাৎ ক্রেতার পণ্যটি নেয়ার আগ্রহ থাকবে, বিক্রেতারও তা বিক্রির আগ্রহ থাকতে হবে। উভয়ে যদি ধার্যকৃত মূল্যে সন্তুষ্ট থাকেন তবেই ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে।
বিক্রেতা যদি জোর করে ক্রেতার ওপর কোনো জিনিস চাপিয়ে দেন অথবা ক্রেতা যদি জোর করে বিক্রেতার সন্তুষ্টি ছাড়াই তার জিনিসটি নিয়ে নেন, তা হলে তা ব্যবসা হবে না; বরং তা হবে জুলুম। আমাদের দেশে দেখা যায়, কেউ ৪৯৫ টাকার কোনো পণ্য কিনে ৫০০ টাকার নোট দিলেন, বিক্রেতা আপনাকে ৫ টাকা ফেরত দেবেন।
কিন্তু ৫ টাকা ফেরত না দিয়ে এর পরিবর্তে তাকে ৫ টাকা দামের একটি চকলেট দিয়ে দিলেন; অথচ ক্রেতার এ চকলেট নেওয়ার কোনো আগ্রহই নেই। ক্রেতার আগ্রহ না থাকলেও শুধু শুধু বিক্রেতার স্বার্থেই তা ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু এখানে উভয়ের সন্তুষ্টি নেই, তাই তা হবে জুলুম। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অপরের ধনসম্পদ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করো না। পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করো।’ (সুরা নিসা : ২৯)।
মিথ্যা বলা বা প্রতারণার মাধ্যমে ভেজাল মাল বিক্রি করলেও সম্পূর্ণভাবে দায়ী হবেন বিক্রেতা। কখনও দেখা যায়, ভেজাল পণ্য বিক্রি করার জন্য ক্রেতা মিথ্যা শপথ করেন। এর মাধ্যমেও ব্যবসা আর ব্যবসা থাকে না; বরং তা হয় প্রতারণা।
যেমন কোনো জিনিস ১০০ টাকায় ক্রয় করে অধিক লাভবান হওয়ার আশায় মিথ্যা শপথ করে বলেন তা ১২০ টাকায় কেনা। এটুক কথাই তার হালাল হারাম হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। মিথ্যাবাদীর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন যে ব্যক্তি তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে। (তিরমিজি : ১০৬)।
ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা সুদের সম্পৃক্ততা করে হালাল ব্যবসাকে হারামে পরিণত করি। ব্যবসার ক্ষেত্রে সুদ দেওয়া, নেওয়া বা এর সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা রাখা যাবে না। আমরা হয়তো মনে করি সুদি ঋণ নিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাব। এ ধরনের চিন্তা কোনো মোমিন তো করতে পারে না। কারণ সুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে কোনো লেনদেন অভিশপ্ত। এতে কোনো বরকত থাকে না। কেননা পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন ও সদকাকে বৃদ্ধি করে দেন।
অর্থাৎ সুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ধরনের লেনদেনই আল্লাহতায়ালার বরকত থেকে বঞ্চিত। যেখানে আল্লাহ নিশ্চিহ্ন করা বা বঞ্চিত করার কথা বলেছেন, সেখানে একজন মোমিন কি এর দ্বারা বরকত বা প্রবৃদ্ধি বা লাভের আশা করতে পারে? সত্যিকার অর্থে সুদি লেনদেন বা সুদ সংযুক্ত ব্যবসায় বাহ্যিকভাবে লাভ দেখা গেলেও তা হয় অন্তরসারশূন্য। অন্যদিকে সুদি লেনদেন পরিহার না করলে তা আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করার নামান্তর।
কুরআনে এসেছে, ‘হে মোমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা মোমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না করো তা হলে আল্লাহ ও তার রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তওবা করো, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের জুলুম করা হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)।
ব্যবসায় মিথ্যা বললে, প্রতারণা করলে হয়তো সাময়িকভাবে কিছু অর্থের মালিক হওয়া যেতে পারে; কিন্তু তা হয় হারাম। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অভিশপ্ত হওয়ায় তা খুব অল্প সময়েই ধ্বংস হয়ে যায়। আর জীবিকা হারাম হওয়ার কারণে তার কোনো নামাজ-রোজা আল্লাহতায়ালার দরবারে কবুল হয় না। পক্ষান্তরে মিথ্যা, প্রতারণা ও সুদি লেনদেনের আশ্রয় না নিয়ে সামান্য লাভ করতে পারলেও তা হয় হালাল। তাতে থাকে প্রভূত কল্যাণ।
জীবিকা হালাল হওয়ার কারণে তার সব ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। সামান্য ইবাদতেই সে আল্লাহতায়ালার নৈকট্যপ্রাপ্ত হয়ে যায়। আবার হালালভাবে ব্যবসা পরিচালনা করায় সে হাশরের ময়দানে এক মহান পুরস্কারে ভূষিত হবেন। তা হলো ওই লোকটি হাশরের ময়দানে বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবেন।
রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘আমানতদার ব্যবসায়ীরা হাশরে নবীদের, সত্যবাদীদের ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (তিরমিজি : ১০২৯)।
লেখক: আলেম, দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স স্নাতকোত্তর) আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া, কিশোরগঞ্জ। শিক্ষার্থী, উচ্চতর ইসলামিক আইন গবেষণা বিভাগ।