শিরোনাম
শাবান মাস এলেই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভিন্নধর্মী এক খুশির আবহ ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বছরের শ্রেষ্ঠ মাস পবিত্র রমজানের আগমনী বার্তা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যায়। এই মাস আনন্দ ও প্রত্যাশার পারদে উচ্ছ্বাসপূর্ণ।
শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তন হয়
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। মিরাজের রাতে মুসলমানদের ওপর নামাজ ফরজের পর থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে নামাজ আদায় করতেন তারা। মুহাম্মদ (সা.) হৃদয় দিয়ে চাইতেন, কাবাঘর হোক মুসলমানদের কিবলা। পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর বানানো ঘর হোক সেজদার নিদর্শন। এজন্য মুহাম্মদ (সা.) নামাজে দাঁড়িয়ে বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন। মনের আকুল প্রার্থনা ব্যক্ত করতেন। ১৬ মাস পর বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবাঘর কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারতি হয় এই মাসে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে এভাবে, ‘বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমণ্ডল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ করি। সুতরাং কিবলার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে দেব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মসজিদুল হারামের (কাবাঘর) দিকে চেহারা ঘোরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, ওই (কাবা) দিকেই মুখ ফেরাও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৪)
বেশি বেশি নফল রোজা রাখা
মুসলমানরা এই মাসে রমজানের জন্য আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি শুরু করে। তারা পরিকল্পনা করে; লক্ষ্য স্থির করে এবং উদ্দেশ্য পানে এগিয়ে চলে। স্বয়ং শাবান মাস সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্য। এ মাস থেকে রাসুল (সা.) রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। পাশাপাশি রমজানের আগমনের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন। অন্যদের প্রতিও শাবান মাসের দিন-তারিখের হিসাবে গুরুত্বারোপ করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) শাবান মাসের (দিন-তারিখের হিসাবের) প্রতি এত অধিক লক্ষ রাখতেন, যা অন্য মাসের ক্ষেত্রে রাখতেন না। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩২৫)
রমজানের রোজা মুসলমান, বালেগ, সুস্থ মানুষের ওপর ফরজ। রমজান ছাড়া ভিন্ন মাসে ফরজ রোজা নেই। তবে অন্য মাসে ও বিশেষ দিনে নফল রোজা রাখায় সওয়াব রয়েছে। রাসুল (সা.) ও সেসব নফল রোজা রাখতেন। সাহাবিদের উদ্বুদ্ধ করতেন। রাসুল (সা.) শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন। অন্য কোনো মাসে এ পরিমাণ রোজা রাখতেন না।
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা কোনো মাসে রাখতেন না। তিনি পুরো শাবান মাসই রোজা রাখতেন এবং বলতেন, তোমাদের মধ্যে যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু (নফল) আমল করো, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) পরিশ্রান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা (সওয়াব) দান বন্ধ করেন না। নবী (সা.)-এর কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় নামাজ ছিল তা-ই, যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হতো, যদিও তা পরিমাণে কম হতো এবং তিনি যখন কোনো (নফল) নামাজ আদায় করতেন পরে তা অব্যাহত রাখতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৭০)
অন্য হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা আর অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প কয়েক দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৭)
আনাস (রা.) বর্ণনা করেন— একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, রমজানের পরে কোন মাসের রোজা সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ? উত্তরে তিনি বলেন, শাবানের রোজা— রমজানের সম্মানার্থে।
(তিরমিজি, হাদিস : ৬৬৩) অন্য এক হাদিসে উম্মে সালমা (রা.) বলেন, আমি মুহাম্মদ (সা.)-কে শাবান ও রমজান মাস ছাড়া কখনো দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৩৬)
মধ্য শাবানের রোজা
শাবান মাসজুড়ে রোজা রাখা ফজিলতপূর্ণ। হাদিসে বহু ধরনের সওয়াবের কথা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া ‘আইয়ামে বিজ’র রোজাও গুরুত্বপূর্ণ। (প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজাকে আইয়ামে বিজ’র রোজা বলে। এই রোজার রাখার ব্যাপারে হাদিসে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।)
পাশাপাশি দুর্বল সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে ১৫ তারিখে বিশেষভাবে রোজা রাখার কথা পাওয়া যায়।
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত সেই হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং পরদিন রোজা রাখো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৪)
ফজিলতপূর্ণ শবে বরাত
মাসে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি রাত রয়েছে। কোরআনের ভাষায় এটাকে লাইলাতুম মুবারকা বলে। আমাদের দেশীয় পরিভাষায় ‘শবে বরাত’ বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন হাদিসে এ রাতের ফজিলতের আলোচনা এসেছে।
মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন—আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫)
শবে বরাতে কি নির্দিষ্ট আমল আছে?
শবে বরাত ও শবে কদরের বিশেষ কোনো আমল নেই। বিশুদ্ধ মতানুসারে এই দুই রাতে একাকী আমল করার কথা রয়েছে। তবে স্বাভাবিক নিয়মে ফরজ নামাজ অবশ্যই মসজিদে পড়তে হবে। এবং জামাতের সঙ্গে আদায় করা জরুরি। তাছাড়া কোনো নফল ইবাদত-বন্দেগি করতে ইচ্ছে হলে— নিজ নিজ ঘরে একাকী করবে। বিভিন্ন বর্ণনায় এ রাতে দীর্ঘ নামাজ পড়া, দীর্ঘ সিজদা করা এবং দোয়া-ইস্তেগফার করার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। (শুআবুল ইমান, বায়হাকি : ৩/৩৮২, ৩৮৩)
শাবানে যে দোয়া বেশি বেশি পড়বেন
রমজানের পরিপূর্ণ ফসল আহরণে রজব মাসের পর শাবানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ সম্পর্কে হজরত আবু বকর বালখি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-‘রজব হলো বীজ রোপনের মাস। আর শাবান হলো ওই বীজে সেচ দেয়ার মাস। অতঃপর রমজান হলো বীজ রোপন ও সেচ দেয়ার পর পরিপূর্ণ ফসল (ফায়েদা) ওঠানোর মাস।’
বরকতময় মাস রমজান পেতে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে বেশি বেশি একাধিক দোয়া করতেন। তাহলো-
- اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَان
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য শাবান মাসকে বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। অর্থাৎ রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করুন।
আবার এভাবেও দোয়া করতেন-
- اَللَّهُمَّ بَلِّغْنَا رَمْضَان وَبَارِكْ لَنَا فِيْهِ وَأعِنَا عَلَى صِيَامِهِ وَقِيَامِهِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা বাল্লিগনা রামাদান ওয়া আইন্না আলা সিয়ামিহি ওয়া ক্বিয়ামিহি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন এবং রমজানে (দিনের বেলায়) রোজা পালন এবং (রাতের জেগে) নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন।’
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য ছিল- আল্লাহ তাআলা যেন এ দোয়ার উসিলায় তার বান্দাদেরকে রমজান মাস জুড়ে অফুরন্ত কল্যাণ লাভের তাওফিক দান করেন।
যেসব কাজ বর্জনীয়
এসব নফল আমলের জন্য মসজিদে সমবেত হতে হয় না। দলে দলে কোথাও একত্রিত হওয়ারও প্রয়োজন নেই। এই রাতে এভাবে আমলের কথা হাদিসের কোথাও উল্লেখ নেই। সাহাবায়ে কেরামের সময়কালেও এমন রেওয়াজ ছিল না। অবশ্য, কোনো ধরনের আহ্বান ও কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়া কেউ মসজিদে একত্রিত হয়ে গেলে ভিন্ন কথা। তখন তারা একাকী ও আলাদাভাবে ইবাদত করবে।
আফসোসের বিষয় হলো, বরকতপূর্ণ এই রাতে এক শ্রেণির অতিউৎসাহী যুবক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। উচ্চস্বরে জিকির ও শব্দ করে। শরিয়তের দৃষ্টিতে এগুলো আবিশ্যকভাবে বর্জনীয়। কারণ অন্যকে কষ্ট দিয়ে নফল ইবাদত করার কোনো বিধান শরিয়তে নেই।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ