শিরোনাম
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে জয় লাভ করে মেয়র হওয়ায় তিনি এখন এই পদে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যমান আইনে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় বিষয়টিকে নতুন অভিজ্ঞতা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীরের মেয়র পদ থাকবে কি না আইন পর্যালোচনা করে তার পরেই বলা যাবে। তবে সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার বলছেন, তার আর মেয়র পদে থাকার বৈধতা নেই।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের নিয়ে একটি মন্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারের তথ্য জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
এদিকে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দল থেকে বহিষ্কার হলে মেয়র পদে থাকতে পারবেন না বলে মনে করেন একজন আইন গবেষক। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, দল থেকে পদ হারালে মনোনয়নপত্রের প্রতীকও হারাবে। সেক্ষেত্রে পদে থাকার কথা নয়।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট করতে ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করা হয়। তখন শুধু দলীয় প্রতীক ও প্রার্থিতার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। মেয়র পদ থেকে অপসারণের বিষয়ে নিয়মের কোনো পরিবর্তন হয়নি। করপোরেশন আইনেও এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে ‘মেয়র ও কাউন্সিলরগণের সাময়িক বরখাস্তকরণ’ অংশে বলা হয়েছে- ১২ (১) সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে ক্ষেত্রমতো মেয়র বা কোনো কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে।
১২ (২) উপ-ধারা (১) এর অধীনে সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়রকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হলে সেই আদেশপ্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্ত মেয়র, ক্রমানুসারে মেয়র প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। মেয়রের বিরুদ্ধে আনা আইনি কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত, অথবা সেই মেয়র অপসারিত হলে, তার পরিবর্তে নতুন মেয়র নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
মেয়র এবং কাউন্সিলরদের অপসারণের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে-
১৩ (১) মেয়র অথবা কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন, যদি তিনি-
(ক) যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন; অথবা
(খ) নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হন;
(গ) দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন;
(ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন;
(ঙ) নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হয়;
(চ) বার্ষিক ১২টি মাসিক সভার পরিবর্তে ন্যূনতম ৯টি সভা গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অনুষ্ঠান করতে, বা ক্ষেত্রমতো, সভায় উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হন।
এখানে ‘অসদাচরণ’ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, এ আইন অনুযায়ী বিধি-নিষেধ পরিপন্থী কার্যকলাপ, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য দেওয়াকে বোঝাবে।
আইনে আরও বলা আছে, অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিধি অনুযায়ী তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরকে পদ থেকে অপসারণ করা হলে, ওই আদেশের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করতে পারবেন এবং আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপসারণের আদেশ স্থগিত থাকবে। সব পক্ষকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ওই অপসারণের আদেশ পরিবর্তন, বাতিল বা বহাল রাখতে পারবেন। আপিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
অপসারিত কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কার্যকালের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন না। তবে দল থেকে বহিষ্কার হলে কী করা হবে সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই।
এদিকে, স্থানীয় সরকারে এ ধরনের ঘটনা না ঘটলেও সংসদে এরকম সমস্যা আগেও হয়েছে। অবশ্য সংসদের ক্ষেত্রেও আইনে স্পষ্ট কিছু নেই। তবে, হজ নিয়ে এক মন্তব্যের পর ২০১৪ সালে পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে প্রথমে মন্ত্রিসভা থেকে এবং পরে আওয়ামী লীগ থেকে বাদ দেওয়া হয়।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে বহিষ্কারের পর জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদে থাকবেন কি না ও স্থানীয় সরকারের পদক্ষেপ কী হবে? জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ টেলিফোনে বলেন, উনি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দলীয়ভাবে বহিষ্কার করলে এখন কী হবে তা আইনগত বিষয়।
সচিব বলেন, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আদালতে চার্জশিট দাখিল করলে এক্ষেত্রে আমরা আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিই। বিষয়টি তলিয়ে দেখে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক এই সচিব আরও বলেন, উনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। দল থেকে বহিষ্কার করেছে, তিনি তো দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত। এটা আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা। এর আইনগত দিক আলাপ আলোচনা করে কাজ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ার পর দল থেকে বহিষ্কার করলে মেয়র পদে তো আর থাকবার সুযোগ নেই। কারণ, দলে তো উনি আর নেই, তাহলে দল থেকে বহিষ্কার করলে তো আর (মেয়রের) চেয়ার থাকে না।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২৬ জুন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম দুই লাখের বেশি ভোটে বিএনপি মনোনীত হাসান উদ্দিন সরকারকে পরাজিত করেন। নৌকা প্রতীকে তিনি ৪ লাখ ১০ হাজার ভোট পান।
সূত্র: জাগো নিউজ