শিরোনাম
‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা অনেক পরামর্শ দিয়েছিলাম। তিনি আমাদের কোনো কথাই শোনেননি। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা তাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছি। ছাত্র-জনতার দাবি মেনে নিতে বলেছি। উনি আমাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি পুলিশ, আনসার, বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতে রিমান্ডে থাকা আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা এসব কথা বলেছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কারণ জানতে চাইলে তারা ডিবি কর্মকর্তাদের বলেন, ‘জয়কালে ক্ষয় নাই মরণ কালে ওষুধ নাই’-এ প্রবাদটি শেখ হাসিনার জন্য সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কারণ গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সবই তার পক্ষে গিয়েছে। আর এবার ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে তিনি যত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সবই তার বিপক্ষে গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ডিবিকে বলেছেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার কারণে এ দেশের মানুষের প্রতি চরম ক্ষোভ ছিল শেখ হাসিনার। তাই তার আচার-আচরণ এমন ছিল যে, দেশের মানুষ মরুক বা বাঁচুক এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। উনি চেয়েছিলেন শুধু ক্ষমতা। আজীবন ক্ষমতায় থাকার লোভ তাকে পেয়ে বসেছিল। এই মানসিকতাই তার জন্য কাল হয়েছে।
ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ১৪ দলের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম ৫ বছর আমি মন্ত্রী ছিলাম। পরের ১০-১১ বছরে আমরা সরকারে ছিলাম না। তবে ১৪ দলে জোটের শরিক ছিলাম। জোটের শরিক হিসাবে আমরা শেখ হাসিনাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছি। ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে বলেছি। যেসব পুলিশ সদস্য ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। টাকা পাচারকারীদের ধরতে বলেছিলাম। উনি চীন সফরে যাওয়ার আগেও বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম।
আমাদের কোনো পরামর্শই কানে নেননি। ইনু ডিবিকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সে কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। অথচ কোটার বিরোধিতা করে। তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে রাস্তায় নামুক।’ এভাবে তার কথা বলা ঠিক হয়নি। ইনু আরও বলেন, ছাত্র আন্দোলন দমনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘তাদের দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ এই মন্তব্যটি ছাত্র-জনতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
গুম-খুনসহ অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন, আমি নিজ উদ্যোগে কিছুই করিনি। আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আমি সেভাবেই কাজ করেছি। আমার কাছে নির্দেশনা আসত একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে। কিছু কিছু বিষয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নির্দেশনা দিতেন।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিষয়ে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সব দোষ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই তারেক সাঈদের। ওই সময় র্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন তারেক সাঈদ। মন্ত্রীর মেয়ের জামাই হওয়ার কারণে ওই সময় তার ওপর কেউ কথা বলতে পারতেন না। জিয়াউল আহসান বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে একসঙ্গে সাতজন নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তাদের খুঁজে বের করতে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) মোখলেসুর রহমান। প্রথমদিকে র্যাব-১১-এর কয়েকজন আমার কাছে সাত খুনের বিষয়টি স্বীকার করেন। কিন্তু তারেক সাঈদ স্বীকার করেননি। জিয়াউল আহসান ডিবিকে জানান, আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানকে সুবিধা দিতেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশেই বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
রিমান্ডে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, ছাত্র আন্দোলন চলাকালে জিয়াউল আহসানের পরামর্শেই ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে জিয়াউল আহসান জানান, পলক নিজের ইচ্ছাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করেছিলেন। আন্দোলনে পুলিশ এবং আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত অন্য বাহিনীর কিছু সদস্যের বাড়াবাড়ি ছিল বলে জানিয়েছেন জিয়া। তিনি বলেন, এত দ্রুত যে সরকারের পতন হয়ে যাবে তা শেখ হাসিনা বুঝতে পারেননি। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, ডিবি হেফাজতে যারা আছেন তারা একেকজন একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছেন। তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, যারা রিমান্ডে আছেন, হত্যার ক্ষেত্রে তাদের কেউ নির্দেশদাতা, কেউ পরামর্শদাতা, কেউ অর্থ বিনিয়োগকারী, কেউ ইন্ধনদাতা। আমরা মূলত হত্যা মামলায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তবে প্রসঙ্গক্রমে আরও অনেক বিষয় চলে আসছে। ওইসব বিষয় আমাদের গোয়েন্দারা নোট করে রাখছেন। মানি লন্ডারিংসহ আর্থিক যেসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় উঠে আসছে সেগুলো নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এর পর থেকে প্রতিনিয়ত গ্রেফতার হচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ইনু, মেনন, পলক ও জিয়া ছাড়া এ পর্যন্ত আরও যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, সাবেক এমপি সাদেক খান, জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, সাংবাদিক দম্পতি শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপা প্রমুখ।