শিরোনাম
রাজধানী ঢাকা ও কুমিল্লায় সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হামলায় শনিবার বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ শতাধিক কর্মী আহত হয়েছেন। কুমিল্লার হামলায় গুরুতর আহত দলটির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু ও তাঁর স্ত্রী শামীমা বরকত লাকীকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় এনে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঢাকার বনানীর হামলায় আহত হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপি নেত্রী শিরিন সুলতানা, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়ালসহ দলটির অন্তত ২০ নেতাকর্মী। গুরুতর আহত তাবিথকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বরকত উল্লাহ বুলু তাঁর নোয়াখালীর গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বিকেলে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের বিপুলাসার বাজারের একটি হোটেলে যাত্রাবিরতি করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাঁর ওপর অতর্কিতে হামলা চালান। এতে বুলুর শরীর রক্তাক্ত হয়। তাঁর স্ত্রী শামীমা বরকত লাকী ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি শরীফ হোসেনসহ অন্তত আট নেতাকর্মী হামলায় আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা এ সময় বুলুর ব্যবহৃত গাড়িটিও ভাঙচুর করে।
এদিকে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং পুলিশের গুলিতে দলের তিন কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে পূর্বঘোষিত মোমবাতি প্রজ্বালন ও মৌন অবস্থান কর্মসূচিতেও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা হামলা করেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এবং উত্তর বিএনপির উদ্যোগে বনানীর কাকলী থেকে গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। বনানীর নির্ধারিত স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীরা আসার আগেই পুরো এলাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দখল করে নেন। এ পরিস্থিতিতে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর একপাশে মোমবাতি হাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান বিএনপির নেতাকর্মীরা। তখন রাস্তার উল্টো দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, রাত পৌনে ৮টার দিকে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচিতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বক্তব্য শেষ করার আগেই ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
হামলার শুরুতে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রথমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। তবে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী লাঠিসোটা নিয়ে একযোগে হামলা করলে সবাই বনানী কে-ব্লকের ২৬ নম্বর রোড দিয়ে সরে যান। এ ঘটনায় ইটপাটকেল ও লাঠির আঘাতে বেশ কয়েকজন আহত হন। এর মধ্যে সেলিমা রহমান ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল রয়েছেন। শামা ওবায়েদ পিঠে আঘাত পান। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
হামলার একপর্যায়ে তাবিথ আউয়াল একটি বাড়িতে ঢুকে পড়লে সেখানে গিয়েও তাঁর ওপর হামলা করা হয়। তাঁকে রক্তাক্ত অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বনানীতে হামলায় ছাত্রদল-যুবদলের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি বিএনপির। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক রুনা লায়লা, তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাহিত্য সম্পাদক আকরাম হোসেনসহ আরও কয়েকজনকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার আগে প্রায় দেড় ঘণ্টা কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর তিন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা মহড়া দিতে থাকেন। এ সময় তাঁদের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মিছিল করতে দেখা যায়। এর আগে সাড়ে ৭টার দিকে দুটি মিছিল থেকে নেতাকর্মীরা বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার উদ্দেশ্যে তেড়ে যান। সে সময় পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ ইউএই মৈত্রী কমপ্লেক্সের সামনে জড়ো হতে থাকেন। সেখানে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম এ কাদের খান, বনানী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি জসিম উদ্দিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর মোশাররফ হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন, বনানী থানা কমিটির সাবেক সভাপতি মো. মাসুদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, বনানী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল বনানী কাঁচাবাজারের পাশে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে অবস্থান নেয়। বিএনপির কর্মসূচির শেষ পর্যায়ে তাঁরা একযোগে হামলা করেন বলে অভিযোগ বিএনপির নেতাকর্মীদের।
বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনাকে মিথ্যাচার দাবি করে আওয়ামী লীগ নেতা কাদের খান বলেন, 'আমরা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে দেখি, বিএনপি কর্মসূচি পালন করছে। এ সময় আমাদের মিছিল বিএনপির কর্মসূচি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে যায়। এরপর জানতে পারি, বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা হয়েছে।'
বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া বলেন, 'দুই দলেরই আলাদা কর্মসূচি ছিল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ করার পর পুলিশ ফিরে আসে। এরপর কারা, কী করেছে- আমরা জানি না। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর নাকি হঠাৎ হুড়োহুড়ি-দৌড়াদৌড়ি হয়েছে; পরে তো চলে গেছে।'
এর আগে সেখানে বক্তব্যে খন্দকার মোশাররফ বলেন, এই স্বৈরাচার সরকারকে হটাতে হলে রাস্তায় ফয়সালা করতে হবে। সে লক্ষ্যে বিএনপি আন্দোলন করছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আজকে আওয়ামী লীগ এ আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করছে। কিন্তু কোনো বাধা এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রুখতে পারেনি।
এদিকে, বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনার পরপরই ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবিরসহ আরও অনেকে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন নস্যাৎ করতে এই আক্রমণ চালিয়েছে। সমগ্র দেশে তারা একটি ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিরাপত্তা বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
পরে এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের উপর মহল থেকেই এ হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ভয় দেখাতে সরকারের এই মরণঘাতী হামলা। সরকার একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনকে চিরস্থায়ী করার জন্য রক্ত ঝরানোর নীতি গ্রহণ করেছে। এ কারণে বিএনপি ঘোষিত সব শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকার বাহিনী ও তাদের দলীয় ক্যাডাররা ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ ভেবেছে, নির্দ্বিধায় এসব অপকর্ম করে যাবে আর বিএনপি চুপ করে থাকবে! এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রতিটি রক্তকণার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। প্রতিটি আঘাতের উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক প্রমুখ।
হাসপাতালে ভর্তি নেতাদের অবস্থার খোঁজ নেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি ও পুলিশের গুলিতে দলের নেতাকর্মীদের নিহত হওয়ার প্রতিবাদে রাজধানীর ১৬টি জায়গায় সমাবেশ ও মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। শনিবার পর্যন্ত সাতটি কর্মসূচির মধ্যে বিনা বাধায় তিনটি কর্মসূচি করতে পেরেছে দলটি। বাকি চারটিতে বিভিন্ন পর্যায়ে বাধা কিংবা হামলা হয়েছে।
কুমিল্লায় হামলা: বুলু ও তাঁর স্ত্রীসহ অন্য নেতাকর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে স্থানীয় যুবলীগ নেতা ইকবাল হোসেন বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা অশালীন স্লোগান দেওয়ার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে আমি শুনেছি। তবে ঘটনার সময় আমি ছিলাম না।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুমিল্লা পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান জানান, বরকত উল্লাহ বুলু ঢাকায় যাওয়ার পথে বিপুলাসারের একটি হোটেলে বসে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা করছিলেন। তাঁর সভার বিষয়টি আগে থেকে পুলিশকে জানানো হয়নি। এ সময় অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নয়াপল্টনে মোমবাতি প্রজ্বালন: ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এ সময় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এভাবেই শান্তিপূর্ণভাবে ভয়াবহ, ফ্যাসিবাদী এবং গণতন্ত্রবিনাশী সরকারকে বার্তা দিতে হবে। গোটা দেশের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। মোমবাতি প্রজ্বালনের মাধ্যমে এই সরকারকে না বলতে হবে। কোনো বাধা মানব না। বিজয় সুনিশ্চিত।
মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে এবং দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকন, আবদুস সালাম আজাদ, ছাত্রদল নেতা কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাইফ মাহমুদ জুয়েলসহ কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।