শিরোনাম
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যার ১০ বছর কেটে গেছে। এখনো শেষ হয়নি তদন্ত, উদ্ঘাটিত হয়নি রহস্য। থানা পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পর এ জোড়া খুনের তদন্ত চালাচ্ছে এলিটফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বহুবার বদল করা হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু কূল-কিনারা হয়নি। অপরাধী চিহ্নিত না হওয়ায় আদালতে দাখিল করা যায়নি অভিযোগপত্র। আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে তদন্ত কর্মকর্তারা এ পর্যন্ত সময় নিয়েছেন ৮৫ বার।
যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামত পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে দুজন পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। বিচার না দেখেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন রুনীর মা। সাগরের মা সালেহা মনিরও একই আশঙ্কা করছেন।
তিনি বলেছেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন লোহার সিন্দুকে রেখে দেওয়া হয়েছে। চাবি হারিয়ে গেছে। তাই প্রতিবেদন দাখিল করা যাচ্ছে না। আমি চাই অন্তত মেঘ (সাগর-রুনীর একমাত্র সন্তান) যেন বিচার দেখে যেতে পারে।’
এদিকে সাগর-রুনী হত্যার এক দশকেও বিচার না হওয়ায় খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার চেয়ে গতকাল রাতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। এছাড়া তিন দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে ডিআরইউ থেকে।
২০১২ সালের এই দিনে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সরোয়ার ওরফে সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনী রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসায় খুন হন।
এ ঘটনায় রুনীর ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার এক উপপরিদর্শক। চার দিন পর তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর ন্যস্ত করা হয়।
দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কয়েকজন কর্মকর্তার হাত বদল হয়ে বর্তমানে র্যাব সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করছেন।
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে শফিকুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামতের ডিএনএ পরীক্ষায় ঘটনাস্থলে দুজন পুরুষ ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে।
ওই দুই অজ্ঞাত আসামিকে শনাক্ত করতে জোর প্রচেষ্টা চলছে। এ মামলায় র্যাব এ পর্যন্ত আট আসামিকে গ্রেফতার করেছে।
এরা হলেন-মিন্টু (বারোগিরা মিন্টু), মো. কামরুল ইসলাম হারুন, বকুল মিয়া, রফিকুল ইসলাম, আবু সাঈদ, এনায়েত আহম্মেদ (হুমায়ূন কবীর), পলাশ রুদ্র পাল ও মো. তানভীর রহমান। এদের প্রথম ছয়জন কারাগারে ও পরের দুজন হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন।
জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শিগগিরই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের লক্ষ্যে কাজ চলছে।
হত্যাকাণ্ডে সন্দেহজনক হিসাবে যাদের নাম আসছে, তাদের সবার ডিএনএ প্রোফাইল আমরা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছি। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ আলামতের সঙ্গে মেলেনি।
তাই দুই অজ্ঞাত পুরুষকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। তিনি বলেন, তদন্তভার পাওয়ার পর র্যাব সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করে এ পর্যন্ত ১৬০ সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। আট আসামিকে বিভিন্ন পর্যায়ে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নত দেশের সহায়তা নিয়েছি।
এদিকে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সবশেষ তারিখ ছিল ২৪ জানুয়ারি। ওইদিন আবারও সময় প্রার্থনা করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এর আগে একইভাবে ৮৪ বার সময় নেওয়া হয়। আদালত সবশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন।
সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, সাগর-রুনী হত্যার বিচার আমার কাছে এখন আকাশ-কুসুম কল্পনা মনে হচ্ছে। তারপরও বিচারের আশা ছেড়ে দেইনি।
বছর আসবে, বছর যাবে-আমি ছেলে ও পুত্রবধূ হত্যার বিচার পাব না কেন? কেন এত কালক্ষেপণ? তিনি বলেন, প্রতিবার যখন আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তারিখ নির্ধারণ করে তখন খুব আশাবাদী হই। কিন্তু যখন আবার সময় প্রার্থনা করা হয় তখন খুবই হতাশ হই।
সালেহা মনির বলেন, র্যাবের কাছে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটা বৃথা যায় না। তারা সবই পারে। কিন্তু সাগর-রুনী হত্যার চার্জশিট কেন দিতে পারছে না, তা আমার বোধগম্য নয়। সরকারের কাছে জোর দাবি, বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখুন।
সাগরের মা বলেন, সিনহা হত্যার বিচার হয়েছে, আরও অনেক হত্যার বিচার হয়েছে। সাগর-রুনী হত্যার বিচার হবে না কেন? আমি খুনিদের চেহারা দেখতে চাই। কেন এ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এর পেছনে রহস্য কী?
তিনি আরও বলেন, বিচার চাইতে চাইতেই রুনির মা পরপারে হারিয়ে গেছেন। আমারও কী একই পরিণতি হবে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি এখনো তসবিহ হাতে বসে আছি।
বিচারের জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছি। সরকার কেন নিশ্চুপ? আদালত কেন চার্জশিট দাখিলের জন্য সময় বেঁধে দিচ্ছেন না? কেউ কেউ সাগর-রুনী হত্যার বিচার চায় না-এ কারণেই হয়তো রহস্য বের হচ্ছে না।
সাগর-রুনী হত্যার বিচার চেয়ে মোমবাতি প্রজ্বালন : সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যার এক দশকেও বিচার না হওয়ায় খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার চেয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় ডিআরইউ চত্বরে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়।
এতে ডিআরইউ সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু, সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম হাসিবসহ অন্য সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় সাগর-রুনীর সন্তান মাহির সারোয়ার মেঘ মোমবাতি প্রজ্বালন করে তার বাবা-মায়ের হত্যার বিচার চায়। এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে ডিআরইউ এবার তিন দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এর মধ্যে শুক্রবার ডিআরইউ চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং রোববার সকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
সূত্র: যুগান্তর