শিরোনাম
নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সুপারিশের মধ্য দিয়ে জনমনে আস্থা অর্জনই সার্চ কমিটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ-এমন মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
তাদের মতে, আগের দুটি সার্চ কমিটির দেওয়া তালিকা থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি যে ইসি গঠিত হয়েছে, তারা পরবর্তীকালে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। বরং নির্বাচনকে একটি প্রহসনে পরিণত করার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে সাধারণ মানুষেরও ভোটের প্রতি একধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আরও অভিমত-এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন দলনিরপেক্ষ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সাহসী, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ইসি গঠন করা। আর এই ইসি গঠনের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন হবে আইনানুযায়ী সার্চ কমিটির দেওয়া নামের তালিকা থেকেই।
এক্ষেত্রে তারা দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে ব্যর্থ হলে ইসি নিয়ে দেশের মানুষ নতুন করে আশাহত হবেন। পাশাপাশি আগামী দিনে অংশগ্রহণমূলক একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যাবে।
এদিকে সার্চ কমিটির চাওয়া নামের তালিকা ইতোমধ্যেই জমা দিয়েছে জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল। আজ দেবে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল। তবে বিএনপি, সিপিবিসহ কমপক্ষে ১০টি দল নামের তালিকা জমা দেবে না।
জানা যায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনারের (ইসি) মোট পাঁচটি পদের বিপরীতে ইতোমধ্যে তিন শতাধিক ব্যক্তির নাম সার্চ কমিটির কাছে জমা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও নাম দিয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ আছেন এই তালিকায়।
গতকাল বাংলাদেশ কংগ্রেসের মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. ইয়ারুল ইসলাম তার দলের পক্ষ থেকে ১০ জনের নাম সার্চ কমিটিতে প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে প্রস্তাব করা দুইজনের নাম হচ্ছে হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। আর নির্বাচন কমিশনার পদে প্রস্তাব করা নামের মধ্যে রয়েছে সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান, সাবেক সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ, মোহাম্মদ জাকারিয়া, সরোয়ার হোসেন, অধ্যাপক শহীদ মনজু, আখতারুল কবির, ড. জহুরুল আলম ও সাইফুল ইসলাম দিলদার।
প্রস্তাবিত এসব নামের সবার জীবনবৃত্তান্তও জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও সার্চ কমিটিতে নাম জমা পড়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যানরাইটস ফাউন্ডেশন থেকে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক দেওয়ান আজাদ পারভেজ নিজের নাম জমা দিয়েছেন।
বিভিন্নভাবে নাম জমা পড়লেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আপাতত বিশিষ্টজনকে নিয়ে অনুষ্ঠেয় বৈঠকের কার্যক্রম গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে শনিবার দুটি এবং রোববার একটি বৈঠক সুপ্রিমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত হবে। এসব বৈঠকে ৬০ জনের বেশি বিশিষ্টজনকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সার্চ কমিটির বৈঠকে তিন ধাপে বিশিষ্টজনের সঙ্গে বসার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী আমন্ত্রণ জানানো প্রায় শেষ হয়েছে। তারপরও যদি কমিটির পক্ষ থেকে নতুন কারও নাম যোগ করতে চায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠিত হতে হবে। তা না হলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। দলীয় আনুগত্যে বিশ্বাসী লোকদের দিয়ে ইসি গঠিত হলে দেশের মানুষ আগামী দিনেও নির্বাচনের নামে প্রহসন দেখবে।
ড. কামাল হোসেন বলেন, সার্চ কমিটির একমাত্র কাজ দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তির তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই আস্থা পুনরুদ্ধারে দরকার গ্রহণযোগ্য ইসি। আইনানুযায়ী সার্চ কমিটি ১০ জনের নামের একটি তালিকা দেবে রাষ্ট্রপতির কাছে। সেই তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং বাকি চারজন কমিশনার ঠিক করবেন তিনি। এখানে দেখার বিষয় সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করে।
তিনি আরও বলেন, অতীতের দুটি সার্চ কমিটি যে ইসি উপহার দিয়েছে, তারা মানুষের প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমি মনে করি, বর্তমান সার্চ কমিটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করে, তা দেখার জন্য দেশবাসী তাকিয়ে আছে। দক্ষ এবং যোগ্য লোক নির্বাচন করাটা তাদের জন্য বড় পরীক্ষা। তবে এটাও ঠিক, যত দক্ষ আর যোগ্য লোকই ইসিতে বসানো হোক না কেন, কাজ হবে না-যতক্ষণ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করা না হবে। প্রশাসনিক চাপ এবং প্রভাবমুক্ত থেকে নির্বাচন করা না গেলে ইসি প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে।
সার্চ কমিটির সদস্যরা মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন এবং ইসি নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের কাছে নাম চেয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে পাঠানা চিঠি পেয়েছে বলে জনা গেছে। জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ কংগ্রেসসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বৃহস্পতিবার আলাদা আলাদাভাবে ১০ জনের নামের তালিকা সার্চ কমিটির কাছে জমাও দিয়েছে।
তবে বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-গণি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)-সহ নিবন্ধিত আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সার্চ কমিটির কাছে কোনো নাম প্রস্তাব করবে না বলে জানিয়েছে। সার্চ কমিটিতে নামের তালিকা জমা দেওয়ার সময় শেষ হচ্ছে আজ বিকাল ৫টায়।
সার্চ কমিটিতে নাম না দেওয়া প্রসঙ্গে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সিইসি এবং ইসি কারা হবেন, সেই নাম তো ঠিক করাই আছে। সরকারি দল আগেই ঠিক করে রেখেছে। এখন যা হচ্ছে তা সে ফ ‘আইওয়াশ’। এজন্য আমরা আর নাম দেওয়ার নাট্যমঞ্চে অংশ নিলাম না। কারণ আমরা জানি, আমাদের মতামতের কোনো মূল্য নেই।
এদিকে সিইসি এবং কমিশনার নিয়োগের ব্যাপারে সার্চ কমিটির দেওয়া নামের তালিকা জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। বৃহস্পতিবার দলটির পলিটব্যুরোর সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সূত্র: যুগান্তর