পলিমার মডিফায়েড বিটুমিনে স্থায়িত্ব বাড়বে সড়কের

ফানাম নিউজ
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:৪৬
আপডেট  : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:৪৭

দেশের সড়ক-মহাসড়কের স্থায়িত্ব বাড়াতে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন বা পিএমবি ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন অংশীজনরা। তারা বলেছেন, পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন রাস্তার স্থায়িত্ব দু-তিন গুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা হবে। আগামী মাসেই প্রকল্পটির মূল কাজ শুরু হচ্ছে। কেএনজি প্রকল্পের তিনটি ব্রিজ, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওভারলেপে পিএমবি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও ব্যবহার হবে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘস্থায়ী সড়ক অবকাঠামো নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি পাশের দেশ ভারতও পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন (পিএমবি) ব্যবহার করছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে উন্নীত করতে হলে টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তাই বাংলাদেশেও বিশেষ করে ভারী ও বেশি যানবাহন চলাচলকারী সড়ক-মহাসড়কে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের সড়কগুলোতে বর্তমানে ১৮ টন ধারণক্ষমতার যানবাহন চলাচলের বিধান আছে। কিন্তু চলছে প্রায় ৪০ টনের বেশি ওজনের যানবাহন। এতে রাস্তা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করলে এই সড়কেই ৫০ থেকে ৭০ টন পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচল করতে পারবে। একসঙ্গে বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারলে পণ্য পরিবহনের গড় খরচও কমে আসবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, যেসব সড়কে ভারী ও অনেক বেশি যানবাহন চলাচল করে, সেসব সড়ক পিএমবি দিয়ে তৈরি করা উচিত। কারণ, পিএমবি ব্যবহার করলে সড়কের স্থায়িত্ব কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রায় বিটুমিনের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় ১৯৮০ সাল থেকে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিনের ব্যবহার হয়ে আসছে। ‘স্টাইরিন বুটাডিন স্টাইরিন’ (এসবিএস) নামক একটি বিশেষ ধরনের পলিমার বেইস বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন তৈরি করা হয়। এই বিটুমিন আর্দ্রতা সংবেদনশীল, নিম্ন তাপমাত্রার নমনীয় এবং উচ্চ তাপমাত্রায় শক্ত থাকে। এটি মহাসড়কের উপরিভাগকে সব ধরনের আবহাওয়াজনিত ক্ষতি, ফাটল বা খানাখন্দ তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা করে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) জানিয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনসহ বিভিন্ন মহাসড়কে বহুল ব্যবহৃত ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছিল। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে সওজকে। তাই সওজ এখন তাদের বড় প্রকল্পগুলোতে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করছে। এই বিটুমিনের চাহিদা বাড়ায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্বমানের পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন উৎপাদন শুরু করেছে বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটি তাদের উৎপাদিত বিটুমিন বিদেশেও রপ্তানি করবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) সহকারী অধ্যাপক ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞ নাজমুস সাকিব বলেন, পলিমার মডিফায়েড বিটুমিনে নির্মিত সড়কের স্থায়িত্ব দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা থেকে কেএনজি প্রকল্পের তিনটি সেতুতে প্রথম পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে কর্ণফুলীর বঙ্গবন্ধু টানেলে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওভারলেপ হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে পিএমবি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পুরোটায়ই পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা হবে বলে জানান তিনি।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম ইলিয়াস শাহ বলেন, আমরা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মূল কাজ আগামী মাসেই শুরু হবে।

নির্মাণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার হোসেন লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মানিক কুমার বিশ্বাস বলেন, পলিমার মডিফায়েড বিটুমিনে করা রাস্তা ৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থেকে (মাইনাস) -২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও কোনো পরিবর্তন হয় না। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে কক্সবাজার এয়ারপোর্টে প্রথম পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করি আমরা। পরে ব্যবহার করা হয় সিলেট এয়ারপোর্টে। তারপর কাঁচপুর-মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণে জাপানিরা ব্যবহার করে। এখন চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টেও পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা হবে। 

বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, কোন ধরনের সড়কে কী বিটুমিন ব্যবহার করতে হবে, বিটুমিন ব্যবহার সংক্রান্ত কমিটিতে আমরা তা নির্ধারণ করেছি। মূলত সড়ক দিয়ে কী ধরনের, কত যানবাহন চলবে, আবহাওয়া, তাপমাত্রা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ইত্যাদি দেখে বিটুমিন নির্বাচন করতে হবে।

তিনি বলেন, পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহারের জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। তাদের মতামত নিয়ে নির্ধারণ করা উচিত কোন সড়কে কোন বিটুমিন ব্যবহার করা যাবে।বর্তমানে দেশে সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা বিটুমিনের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ১২ লাখ মেট্রিক টন। বসুন্ধরা এখন ৫ লাখ মেট্রিক টন বিটুমিন উৎপাদন করে। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, শিগগিরই তাঁরা বিটুমিন রপ্তানি শুরু করতে পারবেন।

সূত্র: বিডি প্রতিদিন