শিরোনাম
দেড় বছর আগে কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় বইয়ে যাওয়া সেই মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত।
গতকাল সোমবার বিকেলে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তদন্তের বরাত দিয়ে বিচারক বলেন, সিনহা হত্যার ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত। প্রদীপ ও লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়।
রায়ে ১৫ আসামির মধ্যে ৬ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন এবং ৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কনস্টেবল সাগর দেব ও রুবেল শর্মা, টেকনাফের মারিশবুনিয়া গ্রামের তিন ব্যক্তি—(পুলিশের সোর্স) নেজাম উদ্দিন, নুরুল আমিন ও আয়াজ উদ্দিন। প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়, অনদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
খালাস পেয়েছেন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া, কনস্টেবল ছাফানুল করিম, মো. কামাল হোসাইন আজাদ, মো. আবদুল্লাহ আল মামুন এবং এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও মো. রাজীব হোসেন।
বহুল আলোচিত এই মামলাটির অভিযোগ গঠনের সাত মাসের মাথায় বিচারকাজ শেষে রায় দিলেন আদালত। রায় ঘোষণাকে ঘিরে গতকাল সকাল আটটা থেকে আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা জোরদার করে পুলিশ। আদালত ভবনের আশপাশের বিভিন্ন সড়কে বসানো হয় তল্লাশিচৌকি। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালত চত্বরে ‘টেকনাফের সর্বস্তরের জনসাধারণের’ ব্যানারে মানববন্ধনে প্রদীপ কুমার দাশের ফাঁসি দাবি করা হয়। এলাকাবাসী প্রদীপের নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। বেলা দুইটার দিকে আসামিদের কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালতে আনা হয়।
সাজা নিয়ে বিচারক যা বললেন
রায় ঘোষণার শুরুতেই জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘রায় প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার। শেষের কিছু অংশ আমি পড়ছি। মূলত খোঁজার চেষ্টা করেছি, ঘটনাস্থল এপিবিএন চেকপোস্টে কেন এই দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটে। একটি প্রশ্নের উত্তর জবানবন্দি এবং আদালতে সাক্ষ্য-জেরা চলাকালেও বারবার খোঁজার চেষ্টা করেছি। এপিবিএন সদস্যরা স্যালুট দিয়ে চলে যেতে বলার পরও কেন আবার মেজর সিনহার গাড়ি থামানো হলো? কেনই–বা গুলি করা হলো।’
বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘এপিবিএন সদস্যরা স্যালুট দিয়ে চলে যেতে বলার পরও কেন হত্যার ঘটনা থামাতে পারলেন না? তাঁদের দায়িত্ব ছিল চেকপোস্ট রক্ষা করা। হলে হয়তো এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না। এ বিষয়ে এপিবিএন সদস্য এসআই শাহাজাহান আদালতে প্রশ্নের জবাবে উত্তর দেন, পাশেই একটা গাছের নিচে লিয়াকত দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১০-২০ সেকেন্ডের মধ্যে গুলি করে দেন। কেন লিয়াকত গুলি করেন, তা সাক্ষী ও আসামিদের সাক্ষ্য ও জবানবন্দিতে জানার চেষ্টা করি।’
পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতের সাজা দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিচারক বলেন, সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে উপর্যুপরি গুলি করেন আসামি লিয়াকত আলী। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সিনহাকে দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে যান। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এবং হত্যার আলামত ধ্বংস করতে সিনহা ও তাঁর সঙ্গী সিফাতের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে লিয়াকত শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
আর প্রদীপের সাজার কারণ জানিয়ে বিচারক বলেন, ‘সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ অপর আসামিদের সঙ্গে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেন। তিনি পূর্বসিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অপর আসামিদের সহায়তায় সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করেন, বুকে লাথি মেরে পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে, গলা চেপে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। হাসপাতালে পাঠাতে দেরি করিয়ে, হত্যার দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মামলার আলামত ধ্বংস করেন, দুটি মিথ্যা মামলা করান।’
আদালতের চিত্র
বেলা ২টা ১৬ মিনিটে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। ৩০০ পৃষ্ঠার রায়ের ১০ পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান তিনি। কক্সবাজার আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় জেলা ও দায়রা জজের এজলাস ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বিচারক পুরো মামলায় আসামি, বাদী ও সাক্ষীদের বক্তব্য উঠে আসা ঘটনার বর্ণনা দেন। আসামিদের কার কী অপরাধ ছিল, সেটা তুলে ধরেন।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দণ্ড ঘোষণা করেন বিচারক। এ সময় খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে নির্বিকার ছিলেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত প্রদীপ ও লিয়াকত। রায় ঘোষণার পুরো সময়ে তাঁরা দুজন আসামির কাঠগড়ায় পাশাপাশি ছিলেন। দু–একবার দুজনকে কানে কানে কথা বলতেও দেখা যায়।
রায় ঘোষণা শেষে আসামিদের প্রিজনস ভ্যানে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় উৎসুক জনতা চিৎকার করতে থাকেন। কয়েকজনকে প্রদীপের নাম উচ্চারণ করে প্রিজনস ভ্যান লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ে মারতে দেখা যায়। এ সময় পুলিশ এক যুবককে আটক করে।
এই সময়ে আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের স্বজনদের অনেককে কাঁদতে দেখা যায়। যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আসামি নুরুল আমিনের মা খালেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে নির্দোষ। পুলিশ যা বলেছে, সে তা করেছে।’
রায় ঘোষণার পর কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ৩১ কার্যদিবসে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নিয়েছি। এতে উঠে আসে ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে আসামিরা সিনহাকে হত্যা করেন। আমরা আশা করেছিলাম, সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’
আসামি প্রদীপের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত ও লিয়াকতের আইনজীবী চন্দন দাশ প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা ন্যায়বিচার পাননি। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। সাজা পাওয়া অন্য আসামিদের আইনজীবীরাও একই কথা বলেন।
কী ঘটেছিল সেই রাতে
৩১ জুলাই, ২০২০। বিকেলে মেজর সিনহা নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘জাস্ট গো’–এর শুটিং করতে সহকর্মী সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) নিয়ে টেকনাফের পাহাড়ে যান। রাত আটটার দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। এরপর নিজের গাড়ি নিয়ে নীলিমা রিসোর্টের দিকে ফিরছিলেন। সাড়ে নয়টার দিকে শামলাপুর এপিবিএনের তল্লাশিচৌকির সামনে তাঁর গাড়ি থামানো হয়। সেখানে একপর্যায়ে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী গুলি করেন সিনহাকে। তাঁর সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর সিনহা যেখানে থাকতেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তাঁর ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে পুলিশ। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
ঘটনার পরপরই পুলিশ তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। তিনটি মামলার দুটি মাদক রাখার অভিযোগে এবং একটি পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে।
পাঁচ দিন পর ২০২০ সালে ৫ আগস্ট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। তাতে টেকনাফ থানার তখনকার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের ৯ সদস্যকে আসামি করা হয়।
সব কটি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। পরে র্যাব এ ঘটনায় ওসি প্রদীপ, লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের ১২ জন পুলিশ সদস্য ও ৩ জন গ্রামবাসী (পুলিশের সোর্স)। পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো সত্যতা না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় র্যাব। হত্যা মামলার তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় র্যাব। আসামিদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গত বছরের ২৭ জুন ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার শুরু হয়।
ওসি প্রদীপ কীভাবে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে টাকার জন্য বন্দুকযুদ্ধ সাজিয়ে খুন করে যাচ্ছিলেন, তা অভিযোগপত্রে উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, তথ্যচিত্র নির্মাণে কক্সবাজারে গিয়ে সিনহা ও তাঁর সঙ্গীরা টেকনাফের নিরীহ মানুষের ওপর ওসি প্রদীপের ‘অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি’ জেনে গিয়েছিলেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে প্রদীপের পরিকল্পনায় সিনহাকে হত্যা করা হয়।
দেশজুড়ে আলোচনা
টেকনাফে ওসি প্রদীপের কর্মকালে ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অনেকগুলো হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেক ভুক্তভোগী পরিবার অভিযোগ করেছেন। মূলত সিনহা হত্যার পর টেকনাফের এই পরিস্থিতি সামনে আসে। তখন দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল সিনহা হত্যার ঘটনা। সেনাবাহিনীর প্রধান ও পুলিশের মহাপরিদর্শক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তখন পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রায় দেড় হাজার সদস্যকে বদলি করা হয়েছিল। সরকার একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিও করেছিল। ওই কমিটি ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে পুলিশের হঠকারী (অবিমৃশ্যকারী), প্রস্তুতিহীন ও অপেশাদারি আচরণ উল্লেখ করে বলা হয়, যথাযথ তদারকি ও জবাবদিহির অভাবে গুলিবর্ষণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে অসংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। আত্মরক্ষার আইনি সুবিধার অপপ্রয়োগ হচ্ছে।
সূত্র: প্রথম আলো