এশিয়ায় ভাসমান সবজির বিছানা বাংলাদেশ, উৎপাদন দেড় লাখ টন

ফানাম নিউজ
  ০২ নভেম্বর ২০২২, ০০:৩৮

ভাসমান সবজি চাষে এশিয়ার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশ। জলাশয়ে ভাসমান বিছানায় সবজি চাষ বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকাতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দশ বছর পূর্বে ভাসমান বেডে সবজি ও চারা উৎপাদন হতো ৫০-৭০ হাজার টন। এখন সবজি ও চারার উৎপাদন ছাড়িয়েছে দেড় লাখ টন। বরিশাল ও পিরোজপুরের মডেল এখন দেশের ২৪ জেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্ষা বিশেষ করে কোনো এলাকা বন্যাকবলিত হলে সবজি ও চারার বড় ত্রাতা হয় ভাসমান বেড পদ্ধতি। এমনকি রাজধানীর ছাদবাগানের চারার সরবরাহ হচ্ছে এ অঞ্চলের ভাসমান বেড থেকে।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল ও পিরোজপুরের চাষীরা বলছেন, বাপ-দাদার আমল থেকেই ধাপ তৈরি করে শাক-সবজি চাষ করে থাকেন তারা। এই চাষে ২০ টাকা খরচ করলে তাতে ৪০-৫০ টাকা আয় হয়। ফলে লাভ থাকে ভালো। ভাসমান বেডে বা ধাপে চাষ করতে বাইরের কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয় না। কচুরিপানায় যে জৈব সার তৈরি হয় তার ওপরই চাষাবাদ করা হয়। কম খরচে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করা যায়। 

নাজিরপুরের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিগ বিজয় হাজরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির প্রভাবে দক্ষিণের কৃষিজমি পানিতে ডুবছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে ক্ষতি হচ্ছে সেটি মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে ত্রাতা হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে ভাসমান ধাপের ওপর শাক-সবজি ও মসলার আবাদ।

কৃষিবিদরা বলছেন, কয়েক দশক ধরেই বরিশাল, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১০-১২টি জেলার কৃষিজমি পাঁচ-ছয় মাস জলাবদ্ধ থাকে। এ অঞ্চলের ধানি জমিতে অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বোরো ধানের চাষ হয়। এরপর জ্যৈষ্ঠ-অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত পাঁচ-আট ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে বেশির ভাগ জমি। বর্ষা ও বর্ষার পর এসব এলাকার দুই লাখ হেক্টরের বেশি নিচু জমি পানিবন্দি থাকায় আগে কোনো ধরনের আবাদ হচ্ছিল না।

এ বিষয়ে কৃষি ডিএইর সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, দেশের ৪৫ লাখ হেক্টর জলসীমার মধ্যে রয়েছে। এই জমির ১০-২০ শতাংশ জমিতে যদি ভাসমান সবজির আবাদ করা যায় তাহলে দেশের সবজি ও মসলা উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। পরিবর্তিত জলবায়ুর অভিযোজন কৌশলে পরিবেশবান্ধব উপায় ভাসমান সবজি ও মসলা চাষ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসও এ পদ্ধতির চাষাবাদে তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এ ছাড়া এখানকার উৎপাদিত চারা পাশের দেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। তখন কৃষকদের আরো দাম দেওয়া সম্ভব হবে।

ভাসমান বেড সম্প্রসারণ

বাংলাদেশ ভাসমান বেড সম্প্রসারণে অনেক কাজ করেছে। মূলত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে সবজি উৎপাদনের এটি একটি বিশেষ কৌশল। ভাসমান এ পদ্ধতিকে স্থানীয় ভাষায় বলে ধাপ পদ্ধতি বা বেড় পদ্ধতি। পানিতে ভাসমান বলে ভাসমান পদ্ধতি। আর কচুরিপানা-টেপাপানা দিয়ে ধাপে ধাপে এ কাজটি সাজানো হয় বলে ধাপ পদ্ধতিও বলা হয়। বাণিজ্যিকভাবে এ চাষ পদ্ধতি জনপ্রিয় করেন পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর ও নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার কৃষকরা। এ পদ্ধতিতে মাটির উৎপাদনশীলতা বেশি থাকে। এ ছাড়া সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদন হয় বলে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয় না। ফলে উৎপাদন খরচও অনেক কম। সামান্য কিছু উপকরণ খরচ ও শ্রমের মাধ্যমেই পানিবন্দি জলাবদ্ধ মানুষগুলো জলাভূমিতে বাণিজ্যিকভাবে ভাসমান ধাপের ওপর ২০-২৫ ধরনের শাক-সবজি, মসলা এবং চারা উৎপাদন করছে।

প্রথম কৃষি ঐতিহ্য স্থাপনা হচ্ছে বাংলাদেশে

বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলাগুলোতে কয়েক দশক ধরেই স্বল্প পরিসরে ভাসমান সবজি চাষ হতো। ২০১০ সালের পরে ব্যাপকতা লাভ করে। ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা সম্প্রসারণ জনপ্রিয়করণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জলাবদ্ধতা আর কচুরিপানার অভিশাপকে এ অঞ্চলের কৃষকদের অভিনব কৌশল এখন প্রথম কৃষি ঐতিহ্য সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের ভাসমান সবজি চাষকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ভাসমান আবাদকে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর গ্লোবাল অ্যাগ্রিকালচার হেরিটেজ সিস্টেম (জিআইএএইচএস) সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।