শিরোনাম
ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন। স্বৈরশাসক আয়ুববিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। মিছিলে মিছিলে সরগরম তৎকালীন পূর্ব বাংলা। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখে রাতারাতি তারকা বনে যান হাওরপাড়ের পাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ও তরুণ কবি।
আন্দোলনের সুতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান হিসেবে লেখা হলো- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ মাত্র দুই রাতেই ‘চিকা’ মারা শেষ। কবি নিজেও তখন ঘোরের মধ্যে। মাত্র একটি কবিতা! বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পেরিয়ে সারাশহর তোলপাড়। অলিতে-গলিতে-রাজপথে গর্জে উঠলো লাইন দুটি। তখন থেকেই নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামের হেলাল হাফিজের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল ‘যৌবনের কবি’ শব্দটি।
সম্প্রতি (৫ সেপ্টেম্বর) ভোরের কাগজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বললেন, এরকম কাণ্ড হবে আমার ধারণারও বাইরে ছিল। আমার নামটিই হারিয়ে গেল। আমাকে দেখলেই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা বলে ওঠে, ওই দ্যাখ, যৌবনের কবি! কেউ কেউ তো আবার জোরে জোরে আবৃত্তিও শুরু করে। কী একটা অবস্থা!
লাখো-কোটি প্রাণে প্রেম-দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া সেই যৌবনের কবি হেলাল হাফিজের আজ জন্মদিন। দ্রোহ-ভালোবাসা-নিঃসঙ্গতার কাব্য বুনে যাওয়া হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার আর মা কোকিলা বেগম। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতার পাশাপাশি আজও কণ্ঠে কণ্ঠে ফেরে অস্ত্র সমর্পণ, অগ্ন্যুৎসব, বেদনা বোনের মতো, ইচ্ছে ছিল, অশ্লীল সভ্যতা, প্রস্থান, যাতায়াত, ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে, হৃদয়ের ঋণ, নাম ভূমিকায়, ইচ্ছে ছিলো, একটি পতাকা পেলে। কাব্যপ্রেমীদের কাছে তিনি কখনো দ্রোহী, কখনো প্রেমিক আবার কখনো বিরহের মূর্তপ্রতীক।
মাত্র ৫৬টি কবিতা নিয়ে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থে জাতির কাব্যিক হৃদয়ে প্রেম-বিরহ-দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ। ১৯৮৬ সালে প্রথম প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের বৈধ সংস্করণের সংখ্যাই ত্রিশের কোঠায়। আর দেশ-বিদেশে অবৈধ সংস্করণ দুইশ ছাড়িয়ে গেছে বলেই ধারণা পাঠক-মহলের। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র ২৬ বছর পর ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। এর চার বছর পর ৩৪টি কবিতা নিয়ে ২০২০ সালে
প্রকাশিত হয়েছে তার তৃতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ : নিষিদ্ধ শিরোনাম ছাড়াও ‘দুঃসময়ে আমার যৌবন’ কবিতায় তার সাহসী উচ্চারণ- ‘মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে/এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই।’ প্রতিবাদ, প্রেম, দ্রোহ জাগানিয়া হেলাল হাফিজ যেন দুঃখবিলাসী তরুলতা। তাই তো ‘দুঃখের আরেক নাম’ শিরোনামের কবিতার শেষ লাইনে কবি নিজেই লিখেছেন, ‘দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।’ প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভালো নেই চির যৌবনের কবি হেলাল হাফিজ। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে অনেক অর্গান। গুরুতর সমস্যা করছে চোখ। কিডনি, ডায়াবেটিস, স্নায়ু জটিলতার মতো সমস্যাগুলো তো রয়েছেই। কিছুদিন পরপরই ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। যদিও হোটেলজীবনকে উপভোগ করেন, নিঃসঙ্গতা-নির্জনতা ভালো লাগে, ভালোবাসেন একাকীত্বের বেদনাকে- তবুও ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে এই একাকিত্বই। মনোচিকিৎসার ভাষায় ‘মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার’।
৩৬ বছর আগে ‘ফেরীঅলা’ কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন/আমার মতো ক’জনের আর/সব হয়েছে নষ্ট,/আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।’ ৩৬ বছর পর শরতের পড়ন্ত বিকালে গরম ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আমার কষ্টগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি হৃষ্টপুষ্ট। অনেক বেশি রঙিন। বৃষ্টি¯œাত সন্ধ্যায় বিজলি আলোর রোশনাইয়ে স্বগতোক্তির মতো বললাম, কষ্টগুলো নষ্ট করে ফের যৌবনের কবিতা লেখার মতো কলম ধরুন। শতায়ু হোন। আমরা অপেক্ষায় আছি আরেকটি ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র জন্য।