শেখ হাসিনা একটি ‘শক্তি’, ওয়াশিংটন পোস্টে ভূয়সী প্রশংসা

ফানাম নিউজ
  ০৫ অক্টোবর ২০২২, ০০:৩২
আপডেট  : ০৫ অক্টোবর ২০২২, ০২:৪৪

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা ১৮ দিনের এই সফরে বেশ ব্যস্ত সময় কেটেছে প্রধানমন্ত্রীর। গত ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথমে লন্ডন যান। সেখানে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং রাজা তৃতীয় চার্লসের অভ্যর্থনায় যোগ দেন। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেন এবং এর পাশে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এই সফরের একাংশে ভার্জিনিয়ার একটি বিলাসবহুল হোটেল অবস্থান করছিলেন তিনি। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন শেখ হাসিনা। 

তার সেই সাক্ষাৎকারটি অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে গত সোমবার (৩ অক্টোবর)। এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমতো প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়েছেন সাক্ষাৎকার নেওয়া কলামিস্ট পেটুলা ডভোরাক।

তিনি শেখ হাসিনাকে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নারী সরকারপ্রধান হওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার চেয়ে বেশি জনসংখ্যা বিশিষ্ট একটি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অন্তত ২০ বার হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা একজন দাদিও বটে। তাই নিজের ৭৬তম জন্মদিন তিনি তার ছেলে ও ১৬ বছর বয়সী নাতনির সঙ্গে উদযাপন করেছেন।

এত ব্যস্ততার মধ্যেও কীভাবে সাধারণ দাদি হওয়ার সুযোগ পান জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, আমি ওদের জন্য রান্না করি। চিকেন বিরিয়ানি… আমার ছেলের বাড়িতে। আমার যে রান্নাঘর রয়েছে, তা কেবলই আমার জন্য।

ডভোরাক লিখেছেন, আমরা তার (শেখ হাসিনা) অনুবাদক এবং চিফ অব স্টাফের সঙ্গে একটি সুন্দর ঘরে বসেছিলাম। সেখানে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিশাল প্রতিকৃতি ছিল, যিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাকে ১৯৭৫ সালে পরিবারের আরও ১৭ সদস্যের সঙ্গে হত্যা করা হয়। দুই মেয়াদে মোট ১৮ বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার বজায় রেখেছেন শেখ হাসিনা।

একটি জটিল, বিপর্যস্ত জাতিকে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘে তিনি মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য সাহায্য চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আশ্রয়কেন্দ্রের জীবন ভালো না। তারা (রোহিঙ্গা) স্বদেশে ফিরতে চায়।

তিনি আরও বলেছেন, তার দেশের অভিবাসন পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকা... একটি বিশাল দেশ। এখানে প্রচুর জমি, প্রচুর জায়গা, কাজের সুযোগ প্রচুর। যুক্তরাষ্ট্রকে কেন অভিবাসীদের নিয়ে চিন্তিত হতে হবে?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৭ কোটির বেশি মানুষ নিয়ে জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে আট নম্বরে রয়েছে। আমরা কিন্তু ছোট দেশ। এসময় তার চিফ অব স্টাফ যোগ করেন, আমাদের (বাংলাদেশ) আকার উইসকনসিনের (যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য) মতো।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে সেন্সরশিপ ও শেখ হাসিনা প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর আগ্রাসী আচরণের অভিযোগও রয়েছে।

অথচ এই কঠোর অবস্থানের জেরেই ২০১৫ সালে বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো-টলারেন্স’ নীতির প্রশংসা করতে গিয়ে ‘নারী হওয়া সত্ত্বেও’ মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার সেই মন্তব্য নিয়ে ভাইরাল বহু মিম (কৌতুক) চালু রয়েছে এবং শেখ হাসিনার জন্য একটি গর্বের জায়গা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রধানমন্ত্রী কিছুটা ঝুঁকে ডভোরাকের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেন, পুরুষদের চেয়ে নারীরা উত্তম। এরপরই হেসে দেন। তারপর বলতে থাকেন, নিজে একজন নারী হওয়ায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও শিক্ষার সংগ্রাম, অধিকাংশ নারী যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন এবং কীভাবে তাদের স্থবিরতা একটি জাতির অগ্রগতিকে ধীর করে দেয়, তা তিনি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন।

শেখ হাসিনা গত এক দশকে তার দেশে উল্লেখযোগ্যভাবে দারিদ্র্য কমিয়েছেন, শিক্ষার সুযোগ প্রসারিত করেছেন এবং আবাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আবাসনকে মানবাধিকার হিসেবে নিয়েছে। আর এটি থাকবে নারী-পুরুষ উভয়ের নামে। এরপর আবারও ফিসফিস করে বলেন, তারা (দম্পতি) যদি আলাদা হয়ে যায়, ঘরটি নারীরা রাখবে। পুরুষেরা নয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে উচ্চ নম্বর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা উল্লেখ করেছে, ১৯৭১ সালে জন্মের সময় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে ২০১৫ সালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশি নারীদের জন্য বিনিয়োগ দেশকে উন্নত করতে সাহায্য করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘে এসব বলার পরে তিনি যখন ভেবেছিলেন, সফরের সবচেয়ে শান্ত অংশটি শুরু করছেন, তখন ভার্জিনিয়ার বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে (প্রধানমন্ত্রী আসার খবর) খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ডভোরাক বলেন, যখন তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারটি শেষ করেন, ততক্ষণে হোটেলের লবিতে ভক্তদের ভিড় লেগে গিয়েছিল।

শেষপর্যন্ত একটি পরিকল্পনা তৈরি হয়। শেখ হাসিনা জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে সম্মত হন। রিটজ-কার্লটন হোটেল কর্তৃপক্ষ চেয়ার-টেবিলগুলোকে তাদের ওল্ড ডোমিনিয়ন রুমের পাশে সরিয়ে নেয়। নিরাপত্তা বাহিনী উপস্থিত অন্তত ২০০ জনকে বলরুমে ঢোকানোর আগে তল্লাশির জন্য একটি লাইন তৈরি করে। এদের অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ। তবে ছয় বছরের শিশু জয়া ও ২৪ বছর বয়সী মালিহা জামানের মতো কিছু নারীও হাজির হয়েছিলেন সেখানে।

বাংলাদেশ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে দু’বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান মালিহা। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এ নারী এখন ভার্জিনিয়ায় বসবাস করেন। তিনি বলেন, অবশ্যই আমি এমন এক নারীকে (শেখ হাসিনা) দেখতে এসেছি, যিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে আজ পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হননি। এমন একটি দেশে শেখ হাসিনার মতো একজন নারী সরকারপ্রধানকে স্বচক্ষে দেখতে পারা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করেন মালিহা জামান।

শাহেদা পারভীন নামে আরেক নারী বলেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) প্রবীণদের কথা ভাবেন, শিক্ষা নিয়ে ভাবেন। তিনি পরিবহন নিয়ে কাজ করেছেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু বানিয়েছেন। তিনি শিশুদের বিষয়ে চিন্তা করেন, তিনি গর্ভবতী নারীদের বিষয়ে যত্নশীল। আমরা সবাই এমনটাই ভাবি।