শিরোনাম
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে সপ্তাহে সাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা চলা বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের কারখানাগুলোতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে সরবরাহ লাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, গত জুনে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি ডলারের বেশি। জুলাই মাসে তা নেমে দাঁড়ায় ৩৩৭ কোটি ডলারে। আগস্টে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৭৪ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত দুই মাসে রপ্তানি আয় কমেছে। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) ক্রমাগতভাবে পণ্য রপ্তানি ক্রয়াদেশ কমেছে।
অন্যতম রপ্তানিবাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ও সমূহ মন্দার কারণে আগামী মৌসুমের জন্য কার্যাদেশ প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমে এসেছে। আগামী মাসগুলোতে এটি আরো কমতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পোশাক মালিকরা। এজন্য রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থায় চাহিদা অনুযায়ী নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করার অনুরোধ জানিয়েছে পোশাক ব্যবসায়ীরা। সেইসঙ্গে এ খাতের উৎসে কর যা এ বছরে ১ শতাংশ করা হয়েছে, সেটি পূর্ববর্তী বছরের ন্যায় একই পর্যায়ে রাখতে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা।
করোনা মহামারিতে গোটা বিশ্বে বিপর্যস্ত অবস্থা দেখা দিলে পোশাক খাতেও তার প্রভাব পড়ে। এক ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আরেক ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছে রপ্তানি আয়ের অন্যতম এ খাতটি। একের পর এক ধাক্কায় চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পোশাক শিল্প। বৈশ্বিক সংকটের কারণে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক ক্রয়ের নতুন আদেশ দেয়া কমিয়ে দিচ্ছেন আশঙ্কাজনক হারে। বিগত কয়েক মাসে গড়ে ৩০-৩৫ শতাংশ রপ্তানি আদেশ কমে গেছে। এর মধ্যে এককভাবে দেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট ঘোষণা দিয়েছে ৩০ শতাংশ অর্ডার কমিয়ে দেবে বিশ্ববাজারে। এতে চরম আতঙ্কে পড়েছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। তারা মনে করেন, আবারো গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে পোশাক শিল্প।
এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোসহ নানা কারণে এমনিতেই উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে পোশাক শিল্পে। এর বিপরীতে পোশাকের দাম বাড়ায়নি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো, উল্টো অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে পোশাক শিল্প আবারো সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলেন, পণ্য জাহাজীকরণে এক ঘণ্টা দেরি হলে ক্রেতারা মানতে চায় না। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে যে আস্থার অবস্থান তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের, তাতে ঘাটতি তৈরি হবে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল শনিবার বলেন, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট চলছে। স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের প্রভাব আমাদের পোশাক শিল্পেও পড়ছে। এতে শিল্পে ব্যয় বাড়ছে দুইভাবে। বিদ্যুতের অপ্রতুলতার কারণে কারখানাগুলোতে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালানো হচ্ছে। অধিক সময় চালানোর কারণে জেনারেটরগুলো ঘনঘন বিকল হচ্ছে। এতে শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমাদের একান্ত অনুরোধ, রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থায় চাহিদা অনুযায়ী নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করা হোক। সেইসঙ্গে আমাদের আরেকটি অনুরোধ, আমাদের উৎসে কর যা এ বছরে ১ শতাংশ করা হয়েছে, সেটি পূর্ববর্তী বছরের ন্যায় একই পর্যায়ে রাখা হোক। ফারুক হাসান বলেন, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত পোশাক শিল্পে টানা প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে গত দুই মাসে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ক্রমাগতভাবে ক্রয়াদেশ কমছে। তিনি বলেন, খুচরা বিক্রেতারা ক্রমবর্ধমানভাবে মুদ্রাস্ফীতির বিশ্ববাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সংগ্রাম করছেন। অনেক ব্র্যান্ডের
পণ্যের খুচরা বিক্রি কমেছে। এতে তাদের অবিক্রিত পণ্য বেড়ে যাচ্ছে। এসব বিবেচনা করে আগামী মাসগুলোতে আমাদের রপ্তানি আরো কমতে পারে।
তিনি বলেন, ফাস্ট ফ্যাশনের এ যুগে আমাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। ফাস্ট ফ্যাশন কনসেপ্টে সাপ্লাই চেইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- যেখানে ঘড়ির কাটা ধরে উৎপাদন, জাহাজীকরণ, পণ্যের ফাস্ট ডেলিভারি করতে হয়। অর্থাৎ উৎপাদন থেকে ডেলিভারি সব ধাপে সম্ভাব্য ন্যূনতম সময়ের মধ্যে কাজগুলো করতে হয়। তাই, বর্তমান পরিস্থিতিতে রপ্তানি তরান্বিত করার জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াগুলো সহজীকরণ, বিশেষ করে কাস্টম, বন্দর এবং বন্ড সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো আরো সহজ করা জরুরি। এগুলো করা হলে আমরা ফাস্ট ফ্যাশনের সুযোগগুলো নিতে সক্ষম হবো।
ফারুক হাসান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন। সফরকালে বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়িক ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শিল্প উৎপাদন, জ্বালানি, অবকাঠামো ও পরিবহন খাতে আরো বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যেহেতু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ঘাটতি বিপুল, তাই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর সব ধরনের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বেনাপোল স্থল বন্দরের আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য অন্য স্থল বন্দর দিয়ে সম্পূর্ণ/আংশিক সুতা আমদানির অনুমোদন দেয়া হলে শিল্প উপকৃত হবে।
তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে ৩১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে পোশাক শিল্পের বিশ্ববাজারে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। ওই সময় দেশের মোট ৮১ কোটি ১০ লাখ ডলার রপ্তানির ৪ শতাংশ ছিল পোশাক পণ্য। এরপর থেকে গত চার দশকে পোশাক খাত দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা মোট রপ্তানির ৮১ দশমিক ৮১ শতাংশ। আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
শুধু রপ্তানিতেই এগিয়েছে তা নয়, দেশের পোশাক খাত রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বড় ধরনের সংস্কারের মধ্যে দিয়ে গেছে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধবও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের স্বীকৃতি অনুযায়ী, বিশ্বের সেরা ১০টি সবুজ কারখানার মধ্যে ৭টি রয়েছে বাংলাদেশে। এর বাইরেও ৫০টি কারখানা প্লাটিনাম, ১০১টি কারখানা গোল্ড, ১০টি কারখানা সিলভার ক্যাটাগরিতে স্থান পেয়েছে।
রপ্তানি খাতকে বিদ্যুৎ রেশনিংয়ের বাইরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, পণ্য জাহাজীকরণে এক ঘণ্টা দেরি হলে ক্রেতারা মানতে চায় না। এতে বৈশ্বিক বাণিজ্যে আমরা যে আস্থার অবস্থান তৈরি করেছি, তাতে ঘাটতি তৈরি হবে। ফলে আমরা মনে করি, সরকার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখবে। কেননা দেশ বর্তমানে ডলারের সংকটেও আছে। এ অবস্থায় রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে, এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখবেন।
লোডশেডিং এবং জ্বালানি তেলের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। আবার মোট উৎপাদনও কমেছে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ। বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, রপ্তানি আদেশ কম থাকা, লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটে কারখানায় উৎপাদন কম হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ।
তিনি বলেন, ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের কারণে বিদ্যুতের চেয়ে গ্যাসের অভাব বড় সমস্যা। ডাইং এবং ফিনিশিং কারখানায়ও গ্যাসের প্রয়োজন। দিনে গ্যাসের চাপ থাকছে না। ডাইং ও প্রিন্টিংয়ের মান খারাপ হচ্ছে। এতে পরিত্যক্ত পণ্যের পরিমাণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ডিজেলে জেনারেটর চালিয়ে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে আছেন উদ্যোক্তারা। ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী যেভাবে হোক পণ্য তাদের হাতে পৌঁছাতে হবে। এভাবে লোকসান হলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানার দীর্ঘদিন লোকসান দেয়ার সামর্থ্য নেই। দেশের ৮০ শতাংশ কারখানাই এ ধরনের।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি খাত চাপে পড়বে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সময় মতো পণ্য ক্রেতাদের হাতে পৌঁছাতে না পারলে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাবেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া সেই ইঙ্গিতই বহন করে।