শিরোনাম
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতার মামলায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তার করেছে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ। গত শুক্রবার বিকালে গ্রেপ্তারের পর গতকাল শনিবার তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
রোববার প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তার এবং কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত মুক্তি দাবি করেছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এ ঘটনায় সিলেটে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের আশঙ্কা করছে সিলেটের নাগরিক সমাজ।
বর্তমান বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে গত ৭ জুলাই অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘জাগোনিউজ২৪.কম- এ মুনতাসীর মামুন ‘নও পাকিস্তানি ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই প্রবন্ধের শেষে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানের তরুণ সমাজের মনোভাব তুলে ধরেন। পাকিস্তানি তরুণদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে, বাংলাদেশের মূল্য কী? তাদের বিনিয়োগ পলিসি অনেক ভালো তাই অনেক বিদেশি রাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের দিকে আকর্ষিত হচ্ছে। তাদের নেতৃত্ব অনেক ভালো। তারা যে পলিসি তৈরি করে তাতে দেখুন বাংলাদেশ আজ কোথায় পৌঁছে গেছে। আজ আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন আর আমি ছবি দেখে (পদ্মা বহুমুখী সেতুর) ভাবছি এটা ইউরোপের একটি কান্ট্রি। কিন্তু এটা আসলে বাংলাদেশ।
পাকিস্তানি জনপ্রিয় টিভি মিডিয়া দ্য টুডের সংবাদদাতা বলেন, আজকে কথা বলব পদ্মা সেতু নিয়ে। করোনা মহামারির ফলে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি যখন খারাপ প্রভাব ফেলছে ঠিক ওই সময়ে বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ করে উদ্বোধন করতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু জুনের ২৫ তারিখ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের এক আবেগের নাম। বাংলাদেশিদের প্রয়োজনীয়তার আরেক নাম পদ্মা সেতু।
প্রবন্ধের শেষাংশে পাকিস্তান পরিস্থিতি বুঝাতে ঊর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক সাদত হাসান মান্টোর একটি ঘটনা উল্লেখ করে পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ভারত ভাগের পর অনেক মুসলমান লেখক থেকে গিয়েছিলেন ভারতে। মান্টো চলে এসেছিলেন পাকিস্তান। নানা নিগ্রহ সহ্য করে দুস্থ অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুর আগে তাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার দেশের খবর কী?’ ‘কারাগারে জুমার নামাজে যে দৃশ্য হয় অবস্থা ঠিক তেমন’ বললেন মান্টো।
‘সেটি কেমন?’ আবার প্রশ্ন। এর জবাবে মান্টো বলেন, ‘আজান দেয় বাটপার, ইমামতি করে খুনি, পেছনে নামাজ পড়ে সব চোরের দল।’ পাকিস্তানের অবস্থা এখনো এ রকম। ফেসবুকে কেন যেন এই মন্তব্যটা বারবার উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আল্লাহ যেন বাংলাদেশকে হেফাজত করেন। শেখ হাসিনাকে সুস্থ রাখেন।
এরপর ৮ জুলাই রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা প্রীতম দাশ তার ফেসবুকে মান্টোর মন্তব্যটি পোস্ট করেন। তখন প্রীতমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার কোনো অভিযোগ উঠেনি। পরবর্তীতে মান্টোর উদ্ধৃতি নিয়ে গত ২৮ জুলাই সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ছেলে এবং মৌলভীবাজার-২ আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম নাসের রহমান নামের ফেসবুক পেজ থেকেও একই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।
এরপর গতমাসে বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নামেন চা শ্রমিকরা। গত ২৭ আগস্ট চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন শ্রীমঙ্গলে একটি ‘সংহতি সমাবেশ’ আয়োজন করে। সেই সমাবেশে স্থানীয় ছাত্রলীগের একটি অংশ হামলা চালায়। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য প্রীতম দাশ ও রিয়াজ খানসহ অন্তত ১০ জন সেই হামলায় আহত হন। হামলার একদিন পর ২৮ আগস্ট গুরুতর আহত অবস্থাতেই হামলাকারীদের নাম প্রকাশপূর্বক তাদের শাস্তির দাবিতে শ্রীমঙ্গল প্রেস ক্লাবে পরপর দুটি সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে প্রীতম হামলাকারীদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে আহ্বান জানান।
ওই সংবাদ সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গলে ব্যাপক জনমত ও সামাজিক ঐক্য তৈরি হয়। ফলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের একাংশের প্রত্যক্ষ মদদে হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতা আবেদ হোসেন প্রীতম দাশের ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে শ্রীমঙ্গলে আগে থেকেই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্রিয় একটি চক্র এই সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় অংশ নেয় এবং শ্রীমঙ্গল শহরে একটি মিছিল বের করে। সেই মিছিলে প্রীতম দাশের ছবি ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছিল যে, প্রীতম ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছেন এবং তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী, তাকে যেন গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর প্রীতমকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে গত ২৯ আগস্ট প্রীতমের পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে ছাত্রলীগ নেতা আবেদ লেখেন, ‘আমি তার ফেসবুকে ৭ জুলাইয়ের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট দিলাম যেখানে সে দেশের অবস্থা নাজেহাল বুঝাতে গিয়ে আমাদের ইসলাম ধর্মকে ব্যঙ্গ করে, জুমার নামাজ, মসজিদের ইমাম এবং নামাজ পড়াকে ব্যঙ্গ করেছে।
তিনি লেখেন, ‘আমি শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসন ও শ্রীমঙ্গল থানার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, এ ধরনের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে যারা পবিত্র ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক কথা বলে তাদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে তারা কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায় তা বের করা দরকার।’
আবেদের এই স্ট্যাটাসের পর তার অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীসহ আরো অনেকে বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এরপর ৩১ আগস্ট প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে উপজেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে ‘শ্রীমঙ্গলের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতা’। সেই মিছিল থেকে প্রীতমকে গ্রেপ্তারে গত শুক্রবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল।
এরপর প্রীতমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে গত ৪ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী মাহবুব আলম ভূঁইয়া। ওই মামলায় গত শুক্রবার সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল শহরের একটি বাড়ি থেকে প্রীতমকে গ্রেপ্তার করা হয়। শ্রীমঙ্গল থানার ওসি (পরিদর্শক-তদন্ত) হুমায়ুন কবির জানান, জনপ্রিয় লেখক মান্টোর একটি উক্তি গত ৮ জুলাই ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রীতম, তার প্রেক্ষিতেই মামলা হয়েছে। গতকাল শনিবার প্রীতম দাশকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের জাতীয় সমন্বয়ক কমিটির অন্যতম সদস্য প্রীতম দাশের দ্রুত মুক্তি দাবি করেছে সংগঠনটি। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের জাতীয় নির্বাহী কমিটির মিডিয়া ও প্রচার সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সংহতি সমাবেশ করায় প্রীতম দাশকে শায়েস্তা করতে রাস্তা খুঁজছিল সরকার। অন্য কিছু না পেয়ে প্রীতম দাশের হিন্দু পরিচয়কে পুঁজি করে তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অভিযোগ দাঁড় করায় স্থানীয় ছাত্রলীগ ও প্রশাসন। তারই জের হিসেবে গণবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই আজ সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার করেছে শ্রীমঙ্গল পুলিশ। প্রীতমের ওপর হওয়া এই জুলুম ন্যায়ের পক্ষে কাজ করা সব মানুষের ওপর জুলুম। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন অবিলম্বে প্রীতম দাশকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে।
প্রীতমকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিলেটের নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কীম। তিনি বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি ছড়াতেই একের পর এক এমন ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। হিন্দুরা কিছু বললেই বলা হচ্ছে ধর্ম অবমাননা। মান্টোর উক্তি অনেকেই ব্যবহার করছেন। কেউ কখনো অবমাননার কথা বলেনি। আজ কেন বলা হচ্ছে। একটি হিন্দু ছেলে লিখেছে বলেই কি এটা হচ্ছে?
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সদস্য রিয়াজ খান জানান, চা শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করে গত ২৭ আগস্ট শ্রীমঙ্গল চৌমোহনায় সমাবেশের আয়োজন করে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। সমাবেশ শুরুর প্রথমে প্রীতম দাশ ও জাবেদ ভূঁইয়াসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী এই হামলা চালিয়েছে অভিযোগ করে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেস ক্লাব ও শ্রীমঙ্গল প্রেস ক্লাবে পৃথক দুটি সংবাদ সম্মেলন করেন প্রীতমসহ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ প্রশাসনের নীরব ভূমিকাকেও দায়ী করে বলা হয়, সংবাদ সম্মেলনের পরপরই প্রীতম দাশের ফেসবুকে গত ৮ জুলাই পোস্ট করা ঊর্দু গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর এক সাক্ষাৎকারের একটি অংশ স্ক্রিনশট দিয়ে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে ৩০ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।