শিরোনাম
রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে গোটা অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের শুধু বহন করাই নয়, আঞ্চলিক হুমকিতেও পড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প এখন বাংলাদেশে। মিয়ানমার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের কোনো দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়, এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির সেমিনার হলে গতকাল ‘রোহিঙ্গা সংকট: প্রত্যাবাসনের পথ’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ এই সেমিনারের আয়োজন করে।
মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরু করতে বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্রকেও যুক্ত করেছে, কিন্তু রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ চেষ্টা করছে প্রত্যাবাসনের কিন্তু এখন পর্যন্ত একজনকেও মিয়ানমার নেয়নি। কোনো মানবিকতা দেখায়নি তারা। আসিয়ান চাইলে প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি বলেন, ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ বহন করে চলেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে প্রত্যাবাসন। প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে, তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আশা করি, ছোট গ্রুপ হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
মানবিক সহায়তার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে এ সময় ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সেমিনারে ঢাকা সফররত জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত নোয়েলীন হেইজার বলেন, রোহিঙ্গারা যে কারণে পালিয়ে এসেছিল সেটিও দূর করা হয়নি। এককথায় রাখাইনের পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এমন অবস্থায় তিনি শরণার্থীদের প্রয়োজন ও উদ্বেগ মেটানোর স্বার্থে প্রত্যাবাসনের আলোচনায় রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা মিয়ানমারের কাজ। যাতে সব শরণার্থী সেখানে ফেরত যেতে পারে, সেটি করার দায়িত্বও মিয়ানমারের। ফেরানোর আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তাদের প্রয়োজন ও উদ্বেগের কথা শোনা, বিবেচনায় নেওয়া ও অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আসিয়ানসহ আঞ্চলিক জোটগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা, তাদের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে কয়েক প্রজন্ম এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের আঞ্চলিক শরণার্থী সমন্বয়কারী ম্যাক্যানজি রোও বলেন, অন্যরা যখন সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার মানুষদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন বাংলাদেশ সেই নিপীড়িত মানুষদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। তারা বিপদগ্রস্ত মানুষকে স্বাগত জানিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, আশ্রিত রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু পাঁচ বছর পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের সেই প্রচেষ্টাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি, বরং পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরেও খারাপ হয়েছে।
ম্যাক্যানজি রোও বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সঙ্গে কিংবা টেকসইভাবে প্রত্যাবর্তন সম্ভব না। এখন তো নয়ই, অদূর ভবিষ্যতেও না। মিয়ানমার নিয়ে আমাদের নিজেদের আরও খোলামেলা আলোচনা করা দরকার। এই সংকট মিয়ানমারে শুরু হয়েছিল এবং এর সমাধান সেখানেই রয়েছে। আমাদের আলাপ-আলোচনায় দোষারোপ কম করে আরও গঠনমূলক ও সমাধানমুখী হওয়া দরকার।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করে ত্রিপক্ষীয় একটি উদ্যোগ নিয়ে চীন, ভারত, জাপানের মতো দেশও এমন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নিতে পারে।
ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো চ্যালেঞ্জিং। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের বিষয়টিও বিবেচনা করা দরকার। তৃতীয় দেশে শরণার্থীদের স্থানান্তর একটি স্থায়ী সমাধান। এটা শরণার্থীদের চাপ আন্তর্জাতিকভাবে ভাগাভাগি করার সুযোগ। জাপান মানবিক সহযোগিতা সবসময়ই দেবে। আমরা চাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হোক।
সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত অ্যানী বেন লিউয়ান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রমুখ।