শিরোনাম
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সমালোচনার মুখে পড়ে রক্ষীবাহিনী। এরই জেরে এখনো আওয়ামী লীগের নেতারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে রক্ষীবাহিনীর ভূমিকা এবং ব্যর্থতার প্রসঙ্গ আনেন। কিন্তু সংস্থাটির তৎকালীন ডেপুটি লিডার (উপপরিচালক) কর্নেল (অব.) সরোয়ার হোসেন মোল্লা দাবি করেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে তারা কার্যকর নিরাপত্তার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিরাপত্তায় রক্ষীবাহিনীকে বত্রিশ নম্বরের আশপাশে ক্যাম্প বসানোর অনুমতি দেননি।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্যের ভিত্তিতে রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তার জন্য বত্রিশ নম্বরের আশপাশে একটি ক্যাম্প বসানোর চেষ্টা করেছিল। তাদের কাছে তথ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হতে পারে। সেই তথ্য এবং তাদের আশঙ্কার কথা তারা বঙ্গবন্ধুকে জানান। তারপরও কী কারণে রক্ষীবাহিনী বত্রিশ নম্বরে ক্যাম্প বসাতে পারেনি, সেই ঘটনা ‘রক্ষীবাহিনীর অজানা অধ্যায়’ গ্রন্থে লিখেছেন সরোয়ার হোসেন মোল্লা।
তার মতে, ‘ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সব সময় স্বভাবসুলভ উদাসীন ছিলেন। তবুও বঙ্গবন্ধুকে আমরা বেশ কয়েকবার বলেছি, বঙ্গবন্ধু, আমাদের কিন্তু অনেক বদনাম আছে। রক্ষীবাহিনীকে আপনার প্রাইভেট বাহিনী বলা হয়। আপনার নিরাপত্তার দায়িত্বটা আমাদের দিন। বঙ্গবন্ধু প্রতিবারই বলেছেন, এই দায়িত্বটা তো পুলিশ ও সেনাবাহিনীর, এটা রক্ষীবাহিনীর নয়।’ সরোয়ার হোসেন মোল্লার মন্তব্য, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) অতিশয় আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বাঙালিরা যে তার ক্ষতি করতে পারে, সেটা তিনি ভাবতেও পারতেন না। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটি তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তা বিধান করা জরুরি হয়ে পড়ল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই. এ. চৌধুরী, রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, আনোয়ারুল আলম (শহীদ), ঢাকার এসপি মাহবুব সাহেব ও আমি একটা বেসরকারি নিরাপত্তা বিধানের চিন্তাভাবনা করি।’
সরোয়ার হোসেন মোল্লা তার রক্ষীবাহিনীর অজানা অধ্যায় গ্রন্থে বলেছেন, ‘সেই অনুযায়ী রক্ষীবাহিনীকে ৩২ নম্বর বাড়ির আশপাশে মোতায়েন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু বিষয়টি সম্পন্ন করতে হবে সম্পূর্ণ গোপনীয়তার মাধ্যমে। কারণ বঙ্গবন্ধু জানতে পারলে এটি তিনি করতে দেবেন না।’ শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের এই আশঙ্কা সত্য হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার নিরাপত্তায় বত্রিশ নম্বরের আশপাশে ওই সংস্থাটিকে ক্যাম্প বসানোর অনুমতি দেননি-এমন দাবি করে গ্রন্থের লেখক বলেন, ‘আমি এবং আনোয়ারুল আলম (শহীদ) ৩২ নম্বর বাড়ির আশপাশে কোথায় রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের রাখা যায়-এমন একটি জায়গা খোঁজ করছিলাম। কোথাও রাখার মতো ব্যবস্থা হলো না। শেষ পর্যন্ত আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে ব্রিজের ওপারে শেখ ফজলুল হক মণি ভাইয়ের বাসার সম্মুখে লেকের পাশে একটি জায়গা পাই। জায়গাটি আবার কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করা ছিল। আমরা কাঁটাতার কেটে সেখানেই বাহিনী রাখার ব্যবস্থা করি। এ বিষয়টি কাউকে জানানো হয়নি। সারা রাত থাকার পরে খুব ভোরে আমরা বাহিনী প্রত্যাহার করে চলে আসি। কিন্তু বিপদ ঘটল অন্যভাবে। মণি ভাইয়ের বাসার কোনো এক লোক আমাদের ওই অবস্থান দেখে মণি ভাইকে বলে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি অন্যধারায় প্রবাহিত হলো।’
পরের ঘটনা-একদিন রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দিন ও কর্নেল সরোয়ার হোসেন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলার জন্য তার (বঙ্গবন্ধুর) সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে যান। ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দিন সঙ্গে করে নিয়ে যান ‘এ ম্যান অন দ্য হর্স ব্যাক (A man on the horse Back)’ নামের একটি বই। ওই বইয়ে পৃথিবীর প্রায় একশ সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যেখানে অতি অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে কীভাবে সামরিক অভ্যত্থান ঘটানো যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ওই বই থেকে কয়েকটি ঘটনা পড়ে শুনানো হয়। তারপরও বঙ্গবন্ধু বত্রিশ নম্বরের আশপাশে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের অনুমতি না দিয়ে তাদের বলেন, ‘বাংলার মানুষ আমাকে মারবে? তোমরা তোমাদের রক্ষীবাহিনী ঠিকমতো চালাও। আমার নিরাপত্তা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।’