শিরোনাম
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক হাফিজুল ইসলাম (৩৫) ১৩ বছর ধরে অ্যাসবেসটস দিয়ে তৈরি ছাউনি ঘরে ব্যবহার করছেন। সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে বৃষ্টির সময় অ্যাসবেস্টসের ছাউনির পানি ধরে রেখে তা পান করেন। তিন বছর আগে শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা ও শরীর জ্বালাপোড়া দেখা দেয়। দিন দিন শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারেন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। গত দুই মাস ধরে ভারতের ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনটি কেমোথেরাপি নিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে তার।
গাবুরার চাঁদনিমুখার গ্রামের আমেনা খাতুন (৪৫) জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে অ্যাসবেসটস ছাউনির বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পান করেন। দীর্ঘদিন পেটের পীড়ায় ভুগছেন। পরে পাকস্থলীর ক্যানসার ধরা পড়ে। সাতক্ষীরার ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মনোয়ার হোসেন তার পাকস্থলীর অপারেশন করেছেন।
ডা. মনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, খনিজ তন্তু অ্যাসবেসটস শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ অ্যাসবেসটোসিস ও ক্যানসারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন।
এর আগে গাবুরার গাইনবাড়ির বাসিন্দা মাসুদুল আলম (৩০) পিত্তথলির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল মারা গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৃষ্টির সময় অ্যাসবেসটসের ছাউনিতে পড়া পানি সংরক্ষণ করে তা পান করায় ক্যানসার ও অ্যাসবেসটোসিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন উপকূলের মানুষ।
অনুসন্ধানে আরও দেখে গেছে, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় লন্ডভন্ড হয়ে যায় দক্ষিণা-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকার মানুষ। আগে এসব এলাকার মানুষ ঘরের চালের ছাউনি হিসেবে গোলপাতা ও খড় ব্যবহার করতেন। সুন্দরবন থেকে গোলপাতা সংগ্রহ করতেন। প্রতি দুই বছর পর পর ঘরের চাল পরিবর্তন করতে হতো। কেউ কেউ টিন ব্যবহার করতেন। কিন্তু লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় বৃষ্টিতে টিন দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ২০১০ সাল থেকে অ্যাসবেসটসের ছাউনি ব্যবহার শুরু হয়। অ্যাসবেসটসের ছাউনি টেকসই হওয়ায় সবার আগ্রহ বেড়ে যায়। গত কয়েক বছরে উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে অ্যাসবেসটসের ছাউনি। কিন্তু অ্যাসবেসটসের বিষাক্ততার কথা কারও জানা ছিল না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কোনও কোনও ডিলার অ্যাসবেসটসের ছাউনিকে সিমেন্ট শিট, আবার কেউ অ্যাসবেসটস বলেই বিক্রি করছেন। শ্যামনগর সদরের সরকারি মহসিন কলেজের পাশে বিভিন্ন ডিলারের মাধ্যমে এটি বিক্রি হলেও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। অবশ্য অ্যাসবেসটস ছাউনির ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা জানেন না ডিলাররাও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্যামনগর সরকারি মহসিন কলেজ এলাকায় বিভিন্ন কোম্পানির রুফ শিট, সিমেন্ট শিট, ঢেউ শিট বিক্রি হচ্ছে। দাম কম হওয়ায় এগুলো শুধু দরিদ্র মানুষরাই কিনছেন না, ধনীরাও কিনছেন।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, প্রতাপনগর, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, রমজাননগর, কৈখালি এবং ইশ্বরীপুরসহ উপকূলীয় বহু ঘরে অ্যাসবেসটসের তৈরি ছাউনি ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু চালে নয়, অনেকের ঘরের বেড়াও অ্যাসবেসটসের তৈরি। এসব গ্রামের মানুষ এটিকে ‘অ্যালবেস্টর’ বলছেন।
গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনী মুখা এলাকার শহীদ গাজী বলেন, ‘আগে চালে খড়ের ছাউনি এবং গোলপাতা ব্যবহার করতাম। কিন্তু প্রতিবছর ঘর ভেঙে যায়। বাধ্য হয়ে অ্যালবেস্টর লাগিয়েছি। ১২ বছর ধরে অ্যালবেস্টর ব্যবহার করছি। পানি সংকটের কারণে চালের পানি ধরে রেখে পান করি। এখন আমি মাথার যন্ত্রণা, শরীর ব্যথা ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। আমার স্ত্রী আমেনা খাতুন পাকস্থলীর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। অপারেশন করাতে হয়েছে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আমি গরিব মানুষ। সুন্দরবনে মধু আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করি। খুবই কষ্টে আছি আমরা। অ্যালবেস্টরের পানিতে ক্যানসার হয় জানলে পান করতাম না।’
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নার্গিস পারভীন বলেন, ‘ছয়-সাত বছর ধরে ঘরের চালে অ্যালবেস্টর ব্যবহার করি। আমাদের এলাকায় সুপেয় পানির সংকট। বর্ষার সময় পানি ধরে তা পান করি। অন্য সময় পুকুরের পানি পান করতে হয়। বৃষ্টির সময় চালের পানি পান করি। বিভিন্ন সময়ে পরিবারের সবাই অসুস্থ হই। বিশেষ করে পেটের পীড়া এবং পানিবাহিত রোগ সারা বছর লেগে থাকে। মেয়েলি রোগ লেগেই আছে। শরীর ব্যথা, জ্বর ও সর্দি-কাশি বছরের অর্ধেক সময় থাকে।’
গাবুরা ইউনিয়নের গাইনবাড়ি এলাকার ইয়াসিন মোড়ল বলেন, ‘ঘরের চালের ছাউনিতে এবং বেড়ায় অ্যালবেস্টর লাগিয়েছি। সুপেয় পানির সংকট থাকায় এলাকার সবাই বৃষ্টির সময় চালের পানি ধরে রাখি ছয় মাসের বেশি সময় পান করি। আমার ছোট ভাই মাসুদুল আলম পিত্তথলির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল মারা গেছেন। তার ক্যানসার কি কারণে হয়েছে জানি না। শুনেছি, অ্যালবেস্টর ছাউনির পানি পানের কারণে এলাকার অনেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি আমরা জানতাম না। এখন মন চায় এ ছাউনি খুলে ফেলি।’
শ্যামনগর সদরের মরিয়ম অ্যাসবেসটস শিটের ডিলার আরিফুজ্জামান মাসুম বলেন, ‘আগে মানুষ গোলপাতা এবং খড় ব্যবহার করতেন। কিন্তু সেটি দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় এখন কম দামে বেশি টেকসই অ্যাসবেসটস শিট ব্যবহার করছেন। এতে ক্ষতিকর কিছু আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে রোদে এটি প্রচণ্ড গরম হয়। আবার দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু অ্যাসবেসটস শিটের পানি পানে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে, তা আমার জানা ছিল না। এ বিষয়ে আমরা মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।’
শ্যামনগর সদরের মেসার্স রিম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আমি আনোয়ার সিমেন্ট শিটের ডিলার। এটি পরিবেশবান্ধব এবং ক্ষতিকর কিছু নেই। তবে অ্যাসবেসটসের ছাউনি পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমি এসব বিক্রি করি না। ঘরে অ্যাসবেসটসের ছাউনি ব্যবহার করলে প্রথমে শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হবে। এটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় ক্যানসার হতে পারে। উপকূলের মানুষ ঘরের ছাউনিতে পড়া বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পান করেন। সে কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে সিমেন্ট শিটে ক্ষতি নেই।’
গাবুরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবিয়ার রহমান বলেন, ‘ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের মাত্র দুই গ্রামে গভীর নলকূপ থেকে সুপেয় পানি পাওয়া যায়। বাকি ১৩ গ্রামের মানুষ পুকুর এবং বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টির সময় ঘরে অ্যাসবেসটসের ছাউনি থেকে সংরক্ষিত পানি ছয় মাস ধরে পান করেন। লবণাক্ত এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হওয়ায় টিন ব্যবহার করতে চান না এলাকার মানুষ। দু’চারটি ছাড়া সব ঘরে অ্যাসবেসটসের ছাউনি। অ্যাসবেসটসের ছাউনির পানি যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটি আমরা গ্রামের মানুষককে বোঝাচ্ছি। বেসরকারি সংস্থা এবং পানি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারাও এ বিষয়ে সচেতন করছেন। তবু কাজ হচ্ছে না। এ জন্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। অনেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের রোগী ঘরে ঘরে আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে আরও ধরা পড়বে।’
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অ্যাসবেসটসের ছাউনির পানি পান করলে কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে, সেটা আমার জানা নেই। তবে উপকূলীয় এলাকার মানুষের পানির সংকট দূর করতে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মাধ্যমে ‘কমিউনিটি বেজড রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ওয়াটারের’ কার্যক্রম চলমান। ২৫ থেকে ৫০টি পরিবার এটিএম থেকে ১০ পয়সা দিয়ে প্রতি লিটার পানি নিতে পারবে। এছাড়া বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা বৃষ্টির পানি ধরার জন্য টিন দিয়ে চাল তৈরি করে দিচ্ছে। এটা থেকে মানুষ পানি নিচ্ছেন। পাশাপাশি অ্যাসবেসটসের বিষয়ে তাদের সচেতন করবো।’
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অ্যাসবেসটস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে। এতে ক্যানসার হয়, এটি বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত। অ্যাসবেসটসের কারণে ফুসফুস, পাকস্থলী, মেয়েদের ওভারিয়ান সিস্ট ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হচ্ছে। অ্যাসবেসটস ব্যবহার নিষিদ্ধ। এটি প্রশাসনের দেখার কথা।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি উপকূলীয় এলাকার মানুষের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরার রোগী বেশি। এই এলাকার ক্যানসার রোগীদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। এ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের শতাধিক ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা করেছি। এর মধ্যে অধিকাংশ রোগী অ্যাসবেসটস ছাউনির পানি পানে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে বলে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছি আমরা।’
জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আনিসুর রহিম বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় ঢেউটিনের পাশাপাশি অ্যাসবেসটস ব্যবহার হচ্ছে। মানুষ অ্যাসবেসটস ছাউনি থেকে পানি পান করছেন। এটি বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা উচিত। অ্যাসবেসটস যারা বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘অ্যাসবেসটস পানি কিংবা অন্য কোনও মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে ক্যানসার ও অ্যাসবেসটোসিসে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। এটি পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। অ্যাসবেসটস থেকে দূরে থাকতে হবে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাতক্ষীরার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অ্যাসবেসটস। এটি বন্ধ করতে না পারলে বিপর্যয় ঘটবে। সে কারণে বিক্রি বন্ধ করে দিতে হবে।’
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আক্তার হোসেন বলেন, ‘অ্যাসবেসটস যে ক্ষতিকর তা আমার জানা ছিল না। তবে সরকারিভাবে এটি কখনও বিতরণ করা হয়নি। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেবো। ক্ষতিকর হলে উপজেলায় কেউ বিক্রি করতে পারবে না। যারা বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন