শিরোনাম
রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট বিভাগসহ সারা দেশ ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে। তেল ও গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল সংকট দেখা দেওয়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বিবিয়ানা গ্যাস প্ল্যান্ট শাটডাউন করায় গ্যাসের অভাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চাহিদার চেয়ে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। এ ঘাটতি পূরণে সারা দেশে লোড ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে।
এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং করে ৩০ মিনিট করে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে লাখ লাখ গ্রাহককে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। একটানা লোডশেডিংয়ে ও আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বৃদ্ধ ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুতের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিদ্যুতের অভাবে সেচযন্ত্র বন্ধ থাকায় চলতি আউশ মৌসুমের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ সম্পর্কে ব্যুরোর পাঠানো খবর :
রাজশাহী : মহানগরীসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তিন দিন ধরে বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। কোনো কোনো এলাকায় দিনে ও রাতে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করে ৩০ মিনিট করে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। কোথাও একটানা তিন-চার ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। অসহনীয় গরমের ভেতরে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন অনেকেই। এদিকে বিদ্যুতের অভাবে সেচযন্ত্র বন্ধ থাকায় চলতি আউশ মৌসুমের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ জানান, গ্রিডলাইন থেকে চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তবে অগ্রাধিকার বিবেচনায় হাসপাতাল বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এলাকায় সরবরাহ চালু রাখার চেষ্টা করছি। তিনি আরও জানান, এ অঞ্চলের আট জেলায় দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ৪৬০ মেগাওয়াট বা তার কিছু বেশি। কিন্তু তিন দিন ধরে সরবরাহ আসছে ৩৭৮ মেগাওয়াটের মতো। এরই মধ্যে রেশনিং করে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ চালু রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তা তিনি বলতে পারছেন না।
অসহনীয় লোডশেডিংয়ে মহানগরীর বিপণিবিতান ও মার্কেট বাজারগুলোতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সন্ধ্যার পরপর দোকানপাট বন্ধ করে লোকজন বাড়ি চলে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। সাহেব বাজারের মুদি ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ না থাকলে দোকানে আমরা বসে থাকতে পারছি না। গরমের মধ্যে ক্রেতারাও দোকানে আসছেন না। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
নগরীর বাইরে গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে জানা গেছে। গোদাগাড়ীর বাসিন্দা আলমগীর কবির বলেন, ২ জুলাই সারারাত এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। ৩ জুলাই সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চারবার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করে। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ এলেও আবার চলে যায় ২০ মিনিট পর। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসেনি।
তানোর উপজেলার পাঁচন্দর এলাকার কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। মানুষের কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার গ্রাহক অন্ধকারে থাকছে।
রংপুর : ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে রংপুর নগরীসহ বিভাগের জনগণ নাজেহাল হয়ে পড়েছে। নগরীসহ বিভাগের আট জেলায় ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও ৫০০ থেকে ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এ কারণে লোডশেডিংয়ের পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। নেসকো বলছে, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে।
নেসকো সূত্রে জানা গেছে-রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় চাহিদার চেয়ে ৪০০ মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়েছে। ফলে অনেক স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে পর্যায়ক্রমে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কোথাও আধা ঘণ্টা আবার কোথাও এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
নগরীর মর্ডান মোড়ের ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান মুকুল জানান, এমনিতেই প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তার ওপর বিদ্যুতের এমন খেলায় জনগণ অতিষ্ঠ। এ পরিস্থিতির উত্তরণ হওয়া জরুরি। গ্র্যান্ড হোটেল মোড় এলাকার ফারুক জানান, ঈদের আগে বিদ্যুতের এ ব্যবস্থা হলে ব্যবসা করব কীভাবে। কারখানা মালিকরা জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে তারা লোকসানের মুখে পড়বেন।
রংপুর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু এবং রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট রেজাউল ইসলাম মিলন জানান, বিদ্যুতের এমন যাওয়া-আসায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ঈদের আগে এমন লোডশেডিংয়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা বেকায়দায় পড়েছেন।
এ ব্যাপারে রংপুর নেসকোর প্রধান প্রকৌশলী সাহাদত হোসেন বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে। অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চলছে।
সিলেট : সিলেট নগরী ও বিভাগজুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন তিন-চারবার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) কর্মকর্তারা জানান, তেল ও গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় পুরো সিলেট বিভাগ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে। দুই দিন ধরে সিলেটে ৫০ মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল সংকট দেখা দেওয়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে বিবিয়ানা গ্যাস প্ল্যান্ট শাটডাউন করায় গ্যাসের চাপও কম। এজন্যও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চাহিদার চেয়ে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার (এনএলডিসি) সারা দেশে লোড ভাগ করে দিচ্ছে।
সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির জানান, ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে তেল সংকট দেখা দিয়েছে। তাই তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পিক আওয়ারে লোডশেডিং করা হচ্ছে। তেল-গ্যাস সংকটের সমাধান না হলে এভাবেই চলতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্নভাবে তেল কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তেল কিনতে করতে একটু সময় লাগবে। তেল কিনতে পারলেই লোডশেডিংয়ের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তবে এটা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
সূত্র: যুগান্তর