শিরোনাম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তার পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক কলামে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির দ্বিমুখী চরিত্র তুলে ধরে দেশটির তুমুল সমালোচনাও করেছেন তিনি।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রশংসনীয় কাজটি করেছেন এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীনের বিনিয়োগকেও স্বাগত জানিয়েছেন।’ মাহফুজ আনাম ‘যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক বক্তব্যের তাৎপর্য’ শীর্ষক তার কলামে ( জুন ৪, ২০২২) একথা বলেন।
‘এই নীতি আমাদের ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে’ মন্তব্য করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চীন বিরোধিতা নিয়েও সতর্ক করেন।
মাহফুজ আনাম বলেন, বেইজিং-নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের বৈরিতার সুযোগ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়ে ফায়দা হাসিলের উপযুক্ত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বিষয়টি আরও গতিশীল হয়েছে।
মাহফুজ আনামের মতে, বাংলাদেশকে এ পরিবর্তনশীল, বিপজ্জনক ও সংঘাতমূলক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দ্রুত সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ভারতের নিজস্ব কিছু সমস্যা থাকার পরও তারা বাইরের কোনো শক্তিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে দেয়নি। ২০২১ সালে এই দুদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা একটি অসামান্য অর্জন।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় মাহফুজ আনাম সমালোচনার ঝড়ের মুখে পড়েন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপ্রমাণিত তথ্য দিয়ে তার পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করে। পরে অবশ্য এক বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে তিনি তার ভুল স্বীকার করেন। তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই না করে সেসব সংবাদ প্রকাশ করা ঠিক হয়নি।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে লেখার শুরুতে ভেনিজুয়েলার উদাহরণ টেনে এনেছেন মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, এক সময় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে উৎখাতে কোনো চেষ্টা বাকি রাখেনি মার্কিন সরকার। বছরের পর বছর দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল।
ডেইলি স্টার সম্পাদক আরও বলেন, এমনকি যারা দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে ও জ্বালানি তেল কিনতে চায়; তাদেরও পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর সেই অবস্থান থেকে সে সরে আসে।
এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে মাদুরো সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে এবং শেভরনকে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কোম্পানি পিডিভিএসের সঙ্গে চুক্তির সুযোগ দেবে।
ডেইলি স্টার সম্পাদকের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজের স্বার্থ রক্ষায় কোন্ ধরনের নীতিমালা গ্রহণ করবে, সেটা একান্তই তাদের বিষয়। তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই ভালো নিতে পারে এবং এ জন্য তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে। তাহলে আমরা যখন একই ধরনের কাজ করতে যাই, তখন কেন সেটি বড় ধরনের ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়?
এরপর ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের একটি মন্তব্য তুলে ধরেন ‘সুশীল সমাজের এ প্রতিনিধি’। সম্প্রতি ডিক্যাবের এক অনুষ্ঠানে পিটার হাস বলেন, মানবাধিকার ও স্বাধীন গণমাধ্যমের বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রয়েছে এবং এ বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দেব না।
তার এ মন্তব্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশে ‘মার্কিনপন্থী’ বলে পরিচিত মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু সৌদি আরব ও ন্যাটো সদস্য তুরস্কের মানবাধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে কী বলবে?
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গণমাধ্যমবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, আমরা মনে করি, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রশ্ন করা ন্যয়সঙ্গত হবে যে, তিনি যদি বাইডেনের পরিবর্তে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিনিধি হতেন, তাহলে কী একই কথা বলতেন? আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসা অসম্ভব কিছু না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা না করুক, সেরকম কিছু যদি হয়েই যায়, তাহলে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন গণমাধ্যমের বিষয়ে একই নীতি বজায় রাখবে?
এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নীতি কতটা টেকসই হবে তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন মাহফুজ আনাম। বলেন, আমাদের কি বিশ্বাস করা উচিত হবে যে, বাইডেন প্রশাসনের নীতি এবং হোয়াইট হাউজের শীর্ষ ব্যক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ধারণার নীতিরও পরিবর্তন হতে পারে? আমাদের কাছে এটাই কী প্রত্যাশা যে, মার্কিন প্রশাসনের সদাপরিবর্তনশীল নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ঢেলে সাজাতে হবে?
ডিক্যাবের অনুষ্ঠানে পিটার হাস বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বাংলাদেশের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু মাহফুজ আনামের প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বুঝবে যে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে?
যেখানে মার্কিন নির্বাচনের দুবছর পার হয়ে গেলেও বেশিরভাগ রিপাবলিকান দলের সমর্থক মনে করেন সবশেষ নির্বাচনে কারচুপি করে তাদের পরাজিত করা হয়েছে এবং তাদের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকৃতপক্ষে জয়ী হয়েছিলেন। আদালতের পক্ষ থেকে অসংখ্যবার এ নির্বাচনের বৈধতার বিষয়ে প্রমাণ ও স্বপক্ষে বক্তব্য দেয়া হলেও মানুষের ধারণা আগের মতোই রয়ে গেছে।
পিটার হাসের কাছে তিনি জানতে চান, যুক্তরাষ্ট্রে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং, ধরে নেয়া যাক, আমরা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করলাম এবং হেরে যাওয়া দলটি দাবি করলো কারচুপির মাধ্যমে তাদের পরাজিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তখন কীভাবে এ ঘটনাকে বিচার করবেন?
চীনের অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ দেখে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা ভীত হয়েছে বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে সরাসরি মোকাবিলা করতে চাচ্ছে। যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
সূত্র: সময় টিভি